ভারতের নাগরিক চিত্র দাস। তাঁর ভোটার পরিচয়পত্র আছে। আছে রেশন কার্ড। এই কার্ড দিয়ে তিনি সরকারি দোকান থেকে কম দামে চাল-গম কিনতে পারেন। অসুখ হলে যেতে পারেন সরকারি হাসপাতালে। তাঁর ছেলেমেয়ের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।
আর ইদ্রিস। তিনি ছিটমহলের বাসিন্দা। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বাস ইদ্রিসের। তাই কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেই তাঁর। কোনো সরকারের সুযোগ-সুবিধাও পান না তিনি। ইদ্রিসের ভাষায়, ‘আমরা কোথাও নেই।’
ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে। এই ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা যেন এতিম। কোনো দেশেরই নাগরিকত্ব নেই তাদের। কয়েক দশক ধরে এই বাসিন্দাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না বাংলাদেশ বা ভারতের সরকার। বিদ্যুৎ বা সড়ক যোগাযোগের মতো কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় না তারা। তাদের ভোটাধিকার নেই।
মধ্য মশালডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দা আবদুল মুতালিব। তিনি বলেন, ‘আমরা এভাবেই জন্মেছি। আমাদের বাবারাও এভাবে জন্মেছেন। কোনো পক্ষই আমাদের দায়িত্ব নেয় না। এখানে আমাদের জমি আছে। আমরা এখন কী করতে পারি? কোথায় যাব আমরা?’
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহলের বিষয়টি খুব শিগগির সুরাহা হতে পারে। গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রটোকল স্বাক্ষর করেছেন। প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতরের ছিটমহলগুলোতে থাকা ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন বাসিন্দা চাইলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবে। একইভাবে ভারতের ভেতরে থাকা ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী ১৪ হাজার ২১৫ জন বাসিন্দা চাইলে ভারতের নাগরিকত্ব পাবে।
এর পর থেকে আশাবাদী হয়ে উঠেছে ছিটমহলের বাসিন্দারা। অবশেষে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে—এই আশায় বুক বেঁধেছে ছিটমহলবাসী।
নালগ্রাম ছিটমহলের বাসিন্দা নাজির হোসেন। তিনি আশাবাদী, শিগগিরই তাঁর নাগরিকত্বের বিষয়টি চূড়ান্ত হচ্ছে। তিনি নিজেকে ভারতীয় বলেই মনে করেন। কিন্তু তাঁর বাড়ি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জমিতে। নাজিরের বাড়ির কয়েক শ মিটার দূরে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি। চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি পড়েছে ভারতে। তাই তারা ভারতের নাগরিক হিসেবে সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা পান। অথচ নাজির হোসেন কোনো সরকারেরই সুযোগ-সুবিধা পান না।
ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব চূড়ান্ত করতে নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, অবশ্যই যেকোনো সরকারকে ছিটমহলবাসীর দায়িত্ব নিতে হবে। ভারত বলছে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক দেশ। তার পরও হাজার হাজার ছিটমহলবাসী দীর্ঘদিন ধরে সত্যিকার অর্থে দেশহীন।
১৯৫৪ সালে একবার ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কিন্তু ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলো ছিটমহল সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
১৯৯২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাও এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেওয়া উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
তবে এখন ছিটমহল সমস্যা সমাধানে আশাবাদী হওয়াই যায়। বাংলাদেশ যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ। আর ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। সূত্র: ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment