আবদুস সাত্তার সালাউদ্দিনের বয়স ৫৭। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কানাডায় বাস করছিলেন। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট সড়কপথে বিশ্বভ্রমণে বের হন। ২২টি দেশ ঘুরে গত বছরের ২৯ মে তিনি নিজ দেশে আসেন, বাংলাদেশে আসেন। আসার সময় পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে তাঁর গাড়িটি জাহাজে তুলে দেন চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে। আশা ছিল, এখানে এসে গাড়িটি নিয়ে সারা দেশ ঘুরে আবার বেরিয়ে পড়বেন বিশ্বের পথে। কিন্তু তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল অপার বিস্ময়।
আবদুস সাত্তার গত বছরের জুনে গাড়িটি ছাড়ের উদ্দেশ্যে যান কমলাপুর আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দপ্তরে। সেখানে তাঁকে জানানো হয়, প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রপ্তানি (চিফ কন্ট্রোলার অব ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট) দপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে। ২২ মে প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে গেলে তাঁকে জানানো হয়, তাঁদের কাছে নয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। আড়াই মাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরির পর গত বছরের ১১ আগস্ট তিনি মন্ত্রণালয়ের ওই ছাড়পত্র পান। ছাড়পত্র নিয়ে সাত্তার যান প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রপ্তানির দপ্তরে। ১৮ আগস্ট তাদের ছাড়পত্র নিয়ে যান চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ে। এবার শুল্ক বিভাগ বলে তাঁকে রাজস্ব অধিদপ্তরে (এনবিআর) যেতে হবে। তাদের ছাড়পত্র লাগবে। সেপ্টেম্বরে এনবিআর কর্মকর্তারা গাড়ির দাম ধরে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিয়ে গাড়িটি ছাড় করানোর পরামর্শ দেন। আবার চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগ। তারা গাড়িটি ছাড় করাতে এক কোটি টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি রাখতে হবে বলে জানান। এত টাকা তিনি পাবেন কোথায়? এটা মাফ পেতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন তিনি।
গত বছরের ১০ নভেম্বর ‘বিশ্বভ্রমণকারীর বাংলাদেশ দর্শন’ শিরোনামে প্রথম আলোয় তাঁর এই খবর প্রকাশিত হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও ১১ মাস। আবদুস সাত্তার এখনো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গাড়িটি ছাড় করার জন্য ছুটছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরের একটিই কথা, ভ্রমণের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নিতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়, যাকে বলে ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’। আসার আগে এই অনুমতি নেননি সাত্তার। এটি থাকলে বিনা শুল্কে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নেওয়া যায়। আবদুস সাত্তার বলছেন, কানাডায় থাকতে বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর জানা ছিল না। অন্য কোনো দেশও এটা চায়নি। ফলে, অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসেনি।
গত এক বছরে কী অগ্রগতি হলো, জানতে চাইলে আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক বছরে গাড়িটি ছাড় করানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর, শুল্ক কার্যালয়, ঢাকার রাজস্ব অধিদপ্তর, নৌ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত ছুটেছেন তিনি। কিন্তু গাড়িটি ছাড় করা হচ্ছে না। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ভাড়া, পোর্ট ট্যাক্স, পার্কিং প্রভৃতি বাবদ গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত তাঁর কাছে সাত লাখ ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। এই টাকা দিয়ে গাড়িটি ছাড় করাতে না পারলে শুল্ক বিভাগ গাড়িটি নিলামে তোলার ঘোষণা দিয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব সৈয়দ ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজস্ব অধিদপ্তরের (এনবিআর) অনুমতি চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ের নিয়ে আসতে পারলেই আমরা তাঁর গাড়িটি ছাড় করাতে পারি। এর আগে আমাদের কিছুই করার নেই। আর বন্দরের কনটেইনার ভাড়া খুব বেশি নয়। কাজেই গাড়িটি ছাড় করাতে হলে তাঁকে শুল্ক ছাড় নিয়ে বন্দরে আসতে হবে।’
বছর খানেক আগে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (আমদানি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিষয়টি রপ্তানি কমিশনার দেখেন। এবারও তিনি একই মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ের কমিশনার (রপ্তানি) জামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভ্রমণে বের হয়ে বিদেশ থেকে কেউ “কারনেট দ্য প্যাসেজ” নিয়ে এলে আমার বিভাগ সেই গাড়ি ছাড় করায়। কিন্তু যেহেতু তিনি সেটি নিয়ে আসেননি, কাজেই এখন এটি আমদানি শাখার বিষয়।’
বিষয়টি উল্লেখ করে ফের সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে কোনো গাড়ি আনতে হলে এলসি খুলতে হয়। শুল্ক দিতে হয়। কিন্তু তিনি কোনোটাই করেননি। এই নিয়ম না মানলে আমাদের পক্ষে গাড়ি ছাড় করানো সম্ভব নয়।’
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বন্দী আবদুস সাত্তারের পাশে এসে একপর্যায়ে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রেসক্লাবের সামনেও মানববন্ধন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের ছাত্র সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় একজন মুক্তিযোদ্ধার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে পরাজিত হতে দিতে পারি না। তাই আমরা তাঁর পাশে থেকে আন্দোলন শুরু করেছি। আমরা চাই, সরকার বিষয়টি সুবিবেচনা করুক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান মুবিনা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁদের দুর্ভোগ শুনে আমাদের বিভাগের একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম পর্যটনমন্ত্রীসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। এমনকি আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবদুস সাত্তারের গাড়িটি ছাড় করানোর জন্য প্রতীকী অনশন ও মানববন্ধন করেছে। কিন্তু আসলে কোনো কাজ হয়নি। আমাদের সরকারি আমলারা সবাই বুঝতে পারছেন, তিনি গাড়িটি নিয়ে কেবল বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছেন। ভ্রমণ শেষেই তিনি আবার চলে যাবেন। আমি মনে করি, সরকারের এ বিষয়ে একটু সদয় দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।’
আবদুস সাত্তার মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার ২০০৬ মডেলের একটি গাড়ি নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এই গাড়ি নিয়েই তিনি বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে চান। কারণ হিসেবে আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি গাড়ি নিয়ে বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে পারলে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশ আর আমার নাম থাকবে। কিন্তু আমি যদি এখন আরেকটি গাড়ি নিই, তাহলেই আর সেটি হবে না।’
আবদুস সাত্তার হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘বিশ্বভ্রমণ আমার স্বপ্ন। এ স্বপ্নের মৃত্যু হলে আমিও মারা যাব। আর সেটি ঘটবে আমারই প্রিয় মাতৃভূমিতে। কষ্টে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। এ পরাজয় আমি মেনে নিতে পারছি না। এর চেয়ে ভালো সরকার আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুক। আমি এই মৃত্যু মেনে নেব।’
0 comments:
Post a Comment