সময় সত্যি
অর্থা ৎ সত্যিই সময় বলে একটা জিনিস আছে। মুঠোফোনের সিম বদলালে যেমন নতুন তারিখ ও সময় ঠিক করতে হয়, কিংবা অ্যালার্ম ঘড়িটি যেমন ঠিক সকাল ছয়টায় বেজে ওঠে, তেমনি সত্য এই সময়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সময়ের প্রকৃতি কতখানি মৌলিক? একসময় আমরা মনে করেছি, তাপমাত্রা বোধ হয় মৌলিক একক। কিন্তু এখন আমরা জানি, এটা আসলে পরমাণুদের গতির একটা ফলাফল। তাই সময়ের প্রকৃতি কতখানি মৌলিক নাকি জটিল সিস্টেম থেকে উদ্ভূত এক ধরনের উন্মেষ—এ প্রশ্নের উত্তর জানা থাকা চাই। অনেকেই মনে করেন, সময় অত্যন্ত মৌলিক একটি প্রপঞ্চ কিন্তু শনের মতে, কোয়ান্টাম গ্রাভিটির পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব হাতে না পেলে এটা বলা আসলেই মুশকিল। যদিও নিউটনের ধারণা ছিল সময় মৌলিক!
অতীথ ও বর্তমান দুই-ই সমানভাবে বাস্তব
আপাততভাবে আমাদের মনে হয় যে কেবল ‘বর্তমানই’ বাস্তব। অতীত কালের গর্ভে গেছে আর আগামীর দেখা আগামীতেই মিলবে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বলে যে বর্তমানের মধ্যেই আছে ভূত-ভবিষ্যতের বীজ।
একেকজনের কাছে সময় একেক রকম ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিদ্যার দিক থেকে বিবেচনা করেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের আলোকে বলা যায়, গতি এক ধরনের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দর্শকের অবস্থান, তার সাপেক্ষে ওই দর্শকের সময় নির্ধারিত হয়। দর্শক যদি আলোর বেগে চলেন কিংবা তিনি যদি কৃষ্ণবিবরের কাছাকাছি থাকেন, তবে পৃথিবীতে টেবিলে লেখারত আমার থেকে তাঁর সময় ভিন্ন হবে। বায়োলজির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণীর নিজস্ব জৈবনিক ছন্দের নিরিখে তার নিজস্ব সময় মাপিত হয়, পারমাণবিক ঘড়ি কী বলল সে অনুযায়ী নয়। এমনকি আমাদের সবার জীবন-জীবিকা, স্মৃতি এক নয়। তাই আমাদের পারস্পরিক অভিজ্ঞতাও ভিন্ন্ন হয়। এবং এ কথা সত্যি যে বুড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ও দ্রুত চলে।
সবাই আমরা অতীতে বাস করি
সঠিক করে বললে ৮০ মিলি সেকেন্ড অতীতে! আমাদের মস্তিষ্ক একটি বিচিত্র ধরনের কাজ করে। একটা সচেতন ঘটনা ঘটতে, সব ইন্দ্রিয় থেকে খবর মস্তিষ্কে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে ৮০ মিলি সেকেন্ডের মতো। কিন্তু মস্তিষ্ক আমাদের এই টাইম-ল্যাগ বুঝতে দেয় না। আপনি এক হাত দিয়ে আপনার চিবুক স্পর্শ করুন, আরেক হাত দিয়ে পায়ের আঙুল স্পর্শ করুন। পায়ের আঙুল থেকে সংকেত আসতে বেশি সময় লাগলেও আপনার মনে হবে ঘটনা দুটি একই সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু কেন? কেউ জানে না।
স্মৃতি বড়ই প্রতারক!
কখনোই আপনি আপনার স্মৃতিকে বিশ্বাস করতে পারেন না! কারণ, মস্তিষ্ক যেভাবে অতীত স্মৃতিকে ঝালাই করে, সেটা ভিডিও করার মতো না। অর্থা ৎ একটা ভিডিও ক্লিপের মতো অতীত স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে না। বরঞ্চ পদ্ধতিটা অনেকটা এ রকম—কেউ একজনের একটা ক্রিপ্ট পড়ে তা থেকে দৃশ্য পুনর্নির্মাণ। ক্রিপ্ট যদি ভুল হয়, তা দৃশ্যও ভুল নির্মিত হবে। এভাবে স্মৃতি এমন এক দৃশ্য মানসপটে ফুটিয়ে তোলে, যা ভুল হলেও সত্যের মতো জ্বলজ্বল করে। অর্থা ৎ ফলস মেমরি একটি অত্যন্ত বাস্তব সমস্যা। ফলে আদালতে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যকে যাচাই করে নিতে হয়।
চেতনার সংঘটন সময়ের ওপর নির্ভরশীল
চিন্তার বিভিন্ন অংশ সময় গণনার ওপর নির্ভরশীল। ডাঙার প্রাণীদের দৃষ্টি কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই কোনো সিদ্ধান্ত বা অ্যাকশন নেওয়ার আগে সে একাধিক বিকল্প ভাবার ফুরসত পায়। বিকল্প সময়ের কল্পনা চেতনার সংঘটনে গুরুত্ব্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সময়ের সঙ্গে বিশৃঙ্খলা বাড়ে
অর্থা ৎ সিস্টেমের এনট্রপি বাড়ে। তাপগতিবিদ্যার এই দ্বিতীয় সূত্রটি সময়ের একমুখী অমোঘ স্রোতকে নির্দেশ করে। গতিবিদ্যার সব সমীকরণে সময়ের প্রবাহকে উল্টে দিলেও তা কাজ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রকৃতি কেবল অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে ধেয়ে যায়। এ জন্য ফাটা ডিম কখনো জোড়া লাগে না, হাত থেকে পড়ে যাওয়া মাত্র গ্লাস আপনাআপনি জোড়া লেগে যায় না, চাল-ডাল মেশালে আর আলাদা করা যায় না ইত্যাদি। পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এনট্রপি বেড়ে চলছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্বের আদিতে বিগব্যাঙের মুহূর্তে এনট্রপি কম ছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ মহাবিশ্বের অন্ত-আদি নিয়ে জটিল সব প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর সাইকেলস অব টাইম বইয়ে।
জটিলতা ক্ষণস্থায়ী
আসে আর যায়। জটিলতা বা কমপ্লেক্সসিটি কোনো সিস্টেমের এনট্রপি বাড়িয়ে দেয়। জড়জগ ৎ থেকে ধাপে ধাপে জীবন ও চৈতন্যের মতো কমপ্লেক্সসিটির আবির্ভাব ঘটেছে এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলার কমবেশি হওয়াটা বেশ জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। একদিকে বলা যায়, কোষপ্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রাণপঙ্কের অভূতপূর্ব লীলা বাইরে জড়জগতের বিশৃঙ্খলা থেকে আলাদা ও অনন্য এক শৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে। অপরদিকে কোষপ্রাচীরের ভেতর-বাইরে বৈষম্য বজায় রাখতে গিয়ে মোটের ওপর এনট্রপি বেড়ে গেছে। অন্তত কোষের বিপাকক্রিয়ার এনট্রপি বাড়িয়ে দিচ্ছে। জটিল সিষ্টেমে কমপ্লেক্সসিটির উন্মেষ এখনো সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়।
চিরযৌবন সম্ভবত অসম্ভব
অর্থা ৎ বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। পুরো ব্রহ্মাণ্ডের এনট্রপি বাড়তে পারে কিন্তু একটি ছোট উপাংশের জন্য এনট্রপি কমানো সম্ভব। যেমন: ফ্রিজের ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে শীতল করা যায়। বার্ধক্য ঠেকানো তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব নয়, এটি কেবল প্রাযুক্তিক চ্যালেঞ্জ—চিকি ৎ সাবিদদের এ রকম মত রয়েছে। ভ্রূণকোষের গবেষণা, ইস্ট, ইঁদুর ও মানুষের পেশি কলার গবেষণায় এ বিষয়ক কিছু সফলতা পাওয়া গেছে।
জীবের আয়ুষ্কাল ১০০ কোটি হূদকম্পন
প্রাণীর দেহ যত বড়, বিপাকের হার ও হূদস্পন্দনও তত ধীর। ইঁদুর বেচারার সাইজ ছোট হলে কী হবে, তার বিপাকের হার বেশি, সারাক্ষণ ক্ষুধা পায় এবং হূদকম্পনও বেশি। একটি পাঁচ টনি হাতির হূদকম্পন মিনিটে ৩০ এবং আয়ুষ্কাল ৬০ বছর; কিন্তু এক আউন্সের একটা ইঁদুরের হূদকম্পন মিনিটে ৭০০ আর তার আয়ুষ্কাল তিন বছরেরও কম। বিজ্ঞানীরা বলেন, হরেদরে সব প্রজাতির আয়ুই ১৫০ কোটি হূদকম্পনের সমান।
সময় নিয়ে এসব প্রাসঙ্গিক ভাবনা একসময় আমাদের সময় সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানতে সাহায্য করবে। সে জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে বৈকি!
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, তড়ি ৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment