পুকুরপাড়ে তালগাছের সারি,
এমন দৃশ্য গ্রামবাংলায় এখন আর খুব সহজলভ্য নয়। বরগুনার আমতলীর আড়পাঙ্গাশিয়া
গ্রাম থেকে ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী রহমান আরিফএখন চলছে পাকা তালের মৌসুম। কোরা নারকেল সহযোগে তালের ক্ষীর, বড়া বা পাটিসাপটা অনেক বাড়িতেই তৈরি হচ্ছে। শহরে কচি তালশাঁসের যেমন কদর ও কাটতি; পাকা তালের অবস্থান ঠিক তার বিপরীত। তবে গ্রামাঞ্চলে ভাদুরে গরমে পাকা তালের ক্ষীর-বড়া এখনো যথেষ্ট লোকপ্রিয়তা নিয়েই বহাল রয়েছে। হাটবাজারে তার উপস্থিতিও যথেষ্ট। গ্রামের লোক শহরে এসেই যে তালের স্বাদ ভুলে তা বর্জন করে, বিষয়টি তেমন নয়। আসলে তাল নামক পিণ্ডাকৃতির সুপক্ব ফলটি থেকে যে প্রক্রিয়ায় রস সংগ্রহ করা হয়, তা বেশ আয়াসসাধ্য। শহুরে ব্যস্ত জীবনে এই ঝঞ্ঝাটে যেতে আপত্তি অনেকেরই। তাই তালের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে চলা।
তালের কথা উঠলেই শিক্ষিতজনের কানে বাজবেই শৈশবে পড়া রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত পদ্য ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...।’ আমাদের একটু বিশেষ আত্মশ্লাঘাও আছে পদ্যটি তিনি আমাদের দেশেই রচনা করেছিলেন বলে। তালগাছ নিয়ে লোকমুখে কেচ্ছা-কাহিনিও কম নেই। জনবিরল খাঁ খাঁ মাঠের মধ্যে এক আদ্যিকালের তালগাছ। তাতে মামদো ভূতের বাসা। ভরদুপুরে অমুক বিলের পাড়ে, মুখ আঁধার সন্ধ্যায় তমুক পাড়ার কোণের তালতলা দিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা ভোররাতে নিজের বাড়ির সীমানায় গাছতলায় তাল কুড়াতে গিয়ে ভূত দেখে ভিরমি খাওয়ার কাহিনি এখনো, এই একুশ শতকের হাইস্পিড ইন্টারনেটের যুগেও একেবারে অচল নয়।
তবে বাস্তবতা হলো, কাকভোরে বা সন্ধ্যায় তাল কুড়াতে গিয়ে আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে অনেকেই সর্প দংশনের শিকার হতেন। ওঝা-বদ্যির ঝাড়ফুঁকে পরিত্রাণ লাভের আশায় আস্থা রেখে প্রাণ হারাতেও হতো অনেককে। এখন অবশ্য ঝোপজঙ্গল কমে গেছে। সাপ-খোপের প্রকোপ কম। তাই অমন দুর্ঘটনার খবর তেমন শোনা যায় না। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে তালতলা দিয়ে অযথা ঘুরঘুর না করাই ভালো। পৃষ্ঠদেশে আকস্মিক পক্ব তাল পতিত হলে সে অভিজ্ঞতা মধুর তো হবেই না, এমনকি অক্কা পাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ থেকেই বাংলার বাগিবধিতে ‘পিঠে তাল পড়া’ কথাটি চালু হয়েছে।
তালগাছে ভূত-পেতনি থাকুক আর না থাকুক, আশ্রয় হিসেবে গাছটি বাবুই পাখিদের খুবই প্রিয়। পাতার সরু ডগায় তারা যে বাসা বুনে থাকে, সেটি চিরকালের এক ধ্রুপদি শিল্পকর্ম। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বিড়াল, খাটাশ, বাদুড় প্রভৃতি প্রাণী ও পাখি আশ্রয় হিসেবে এ গাছটিকে বেছে নেয়।
তালগাছ নিয়ে ‘নুড়ি ও তালগাছ’ নামে চমৎকার একটি গল্প আছে বনফুলের। খুবই ছোট্ট। সাহিত্যানুরাগীরা তো জানেনই তাঁর গল্প মানেই বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন। এ গল্পটিও তাই। বিরাট প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক নিঃসঙ্গ তালগাছ। তার তলায় পড়ে আছে এক ছোট্ট পাথরের নুড়ি। ছোট ছোট ঘাস নিয়েই তার ভুবন। বিশাল তালগাছ তার কাছে এক বিপুল বিস্ময়। সে তাকে জিজ্ঞাসা করছে, আপনি কে? অত উঁচুতে আপনি কী দেখেন, ইত্যাদি। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
আমাদের অতি চেনা গাছটির আদিনিবাস এ দেশে নয়, সুদূর আফ্রিকায়। তবে বহুকাল আগে এখানে তার আগমন। বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellier। ধীরগতির বৃদ্ধি। ফল ধরতে বছর ত্রিশেক লাগে। বসন্তের শেষে ফুল আসে, ফল পাকে শরতে। শক্তপোক্ত কাণ্ড। কাঠ ঘরের করিবর্গা, খুঁটিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহূত হয়। গ্রীষ্মকালে তালপাতার পাখা এখনো বিদ্যুৎবিভ্রাটকবলিত শহুরে নাগরিকের হাতেও পরম স্বস্তির উপকরণ। উপরন্তু কাগজ চালু হওয়ার আগে তালপাতা লেখার উপকরণ হিসেবে বহুল ব্যবহূত হয়েছে। ‘তালপাতার পুঁথি’র কথা কে আর না জানেন। খেলনা হিসেবে ‘তালপাতার সেপাই’র পরিচিতিও কম নয়। আর তালের আঁশের টুপিকে বিখ্যাত করে গেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। অতএব দেখাই যাচ্ছে, একদা আফ্রিকান তাল বঙ্গে এসে দিব্যি চলছে তাল মিলিয়ে।



0 comments:
Post a Comment