বাংলা ক্যালেন্ডার যা বাংলা সাল নামে পরিচিত তা ১৫৮৪ সালে ,মুঘল সম্রাট আকবরের সময় সরকারীভাবে চালু করা হয়। এটা প্রথমে তারিখ-এ-এলাহি নামে পরিচিত ছিল এবং ১৫৮৪ সালের ১১ মার্চ চালু করা হয়। যদিও এটা আকবর-এর রাজত্বের ২৯ বছর চালু করা হয় তবুও এর গননা করা হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সাল থেকে যখন সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন।
উৎপত্তির কারণ
তারিখ-এ-এলাহি-র উদ্দেশ্য ছিল আকবর রাজত্বকে আরো গৌরবময় করে তোলা এবং রাজস্ব আদায়ে কিছু সুবিধার জন্য। এর আগে মোঘল সম্রাট হিজরী সাল ব্যবহার করছিলেন রাজস্ব আদায়ের কাজে। কিন্তু হিজরী সাল ব্যবহার এর কারণে কৃষকদের সমস্যা হত কারণ চন্দ্র ও সৌর বছরের মধ্যে ১১ বা ১২ দিনের পার্থক্য ছিল। ফলে ৩১ টি চন্দ্র বছর ৩০ টি সৌর বছর এর সমান হয়ে যেত। এখন রাজস্ব চন্দ্রবছর অনুযায়ী আদায় করা হত আর চাষাবাদ করা হত সৌরবছর অনুযায়ী। সম্রাট আকবর তার শাসনের প্রথমেই এই সমস্যা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং এর একটি বৈজ্ঞানিক কিন্তু কার্যকার সমাধান খুঁজছিলেন। তাই তিনি প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক এবং জ্যোতির্বিদ আমির ফাতুল্লাহ শিরাজীকে পরিবর্তন আনার আদেশ দেন।
এখন, ৯৬৩ মহররমের প্রথম মাসকে তারিখ-এ-এলাহির প্রথম মাস ধরে গননা করা শুরু হয়। যেহেতু ৯৬৩ মহররমের প্রথম মাস বৈশাখ মাসের সাথে মিলে যায় তাই বৈশাখই হয় তারিখ-এ-এলাহি-র প্রথম মাস।(আগে শাকাব্দ অনুযায়ী চৈত্র মাসকে প্রথম মাস হিসেবে ব্যবহার করত বাঙ্গালীরা)
তারিখ-এ-এলাহি-র শুরুর পর যে ৪০০+ বছর অতিবাহিত হয়েছে তাতে হিজরী এবং বাংলা সালের মধ্যে ১৪ বছরের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, কারণ হিজরী হিসাব করা হয় চন্দ্রকে ভিত্তি করে আর বাংলা সাল হিসাব করা হয় সূর্যকে ভিত্তি করে। কিন্তু বাংলা সাল আর গ্রেগরিয়ান সাল-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য হয়নি কারণ উভয়-ই সূর্য-কে ভিতি করে গননা করা হয়।
আকবরের রাজত্বের সময় মাসের প্রত্যেকদিনের আলাদা নাম ছিল। কিন্তু যেহেতু মাসের ৩১দিনের ৩১টা নাম মনে রাখা কষ্টকর তাই আকবরের প্রপৌত্র শাহজাহান সপ্তাহ পদ্ধতির সুচনা করেন তার ফসলী সাল পদ্ধতিতে। তার সময়কার সপ্তাহের নামকরণঃ
১.সূর্য এর জন্য রবি(Sunday)
২. চাঁদ এর জন্য সোম(Monday)
৩.মঙ্গল গ্রহ এর জন্য মঙ্গল(Tuesday)
৪. বুধ গ্রহের জন্য বুধ(Wednesday)
৫. বৃহস্পতি গ্রহের জন্য বৃহস্পতি(Thursday)
৬.শুক্র গ্রহের জন্য শুক্র (Friday)
৭.শনি গ্রহের জন্য শনি(Saturday)
প্রথমদিকে মাস এর নাম ছিল ফারওয়ারদিন, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আযার, দে, বাহমান etc. এটা জানা যায় নি যে কেন মাস গুলোর নাম এখন বৈশাখ জৈষ্ঠ দেয়া হয়েছে তবে মনে করা হয় যে ৭৮খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শাকাব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। মাসের নামঃ
২.জাইষ্ঠা(Scorpii) থেকে জৈষ্ঠ
৩.আষাঢ়া(Sagittarii) থেকে আষাঢ়
৪.শ্রাবনা(Aquilae) থেকে শ্রাবন
৫.ভাদ্রপাদা(Pegasi) থেকে ভাদ্র
৬.আশ্বিনী(Arietis) থেকে আশ্বিন
৭. কৃতিকা(Tauri) থেকে কার্তিক
৮. পুস্যা(Aldebaran) থেকে পৌষ
৯.আগ্রৈহনী(Cancri) থেকে আগ্রহায়ন
১০.মাঘা(Regulus) থেকে মাঘ
১১.ফাল্গুনী(Leonis) থেকে ফাল্গুন
১২.চিত্রা(Virginis) থেকে চৈত্র
বাংলা সালের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন। কিন্তু পৃথিবীর সুর্য কে প্রদক্ষিন করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য গ্রেগরিয়ান সালে প্রতি চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারী মাসের সাথে একদিন যোগ করা হয়(শুধু যে শত বছর ৪০০ দিয়ে ভাগ হয় সে বছর যোগ করা হয় না)। শুরুর দিকে বাংলা সাল এই অতিরিক্ত সময়কে গননায় নেয় নি। পরে এই ঘাটতি দূর করার জন্য বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধায়নে এবং মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের পরিচালনায় একটা কমিটি গঠন করা হয় ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী। পরে কমিটির সুপারিশ-এ বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রত্যেক মাস কে ৩১ দিনের এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস গুলো ৩০ দিনের হিসাবে গননা করা শুরু হয়। আর প্রতি চার বছর পর পর চৈত্র মাস কে ৩১ দিন ধরা হয়।
0 comments:
Post a Comment