ক্রেতার দিকে ছলছল চোখে চেয়ে বলল, ‘ভাই, কিছু কিইন্যা দেন, সকাল থাইক্যা কিছু খাই নাই।’ অনেক অনুনয় আর বিনয়ের পর আধখান পাঁপড় জুটল। সেটা খেয়ে তারপর আবার দৌড়াল বন্ধুদের কাছে। ওর নাম সজীব। বয়স ছয়। বাড়ি ভৈরবে। বর্তমান ঠিকানা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। প্রশ্ন করলাম, ‘সারা দিন কি এখানেই থাকো?’
প্রশ্ন শুনেই যেন কথার খই ফুটতে লাগল, ‘হ, এইখানে থাকি। আর ফুল বেচি।’ পাশের বন্ধুদের দেখিয়ে বলল, ‘হেরাও এই কাম করে।’
সারা দিন কি এই সবই খাও?
পাশে দাঁড়ানো আলাদিন এবার কথা বলল, ‘সকালে আমরা রুটি আর চা খাই। তারপর ফুল বেচতে এই খানে আইস্যা পড়ি। এই খানে আমরা অনেক কিছু খাই। আইসক্রিম, কোক, লাচ্ছি, পাঁপড়, আলুর চিপস, ফুচকা খাই। কেমনে খাই, জানেন? যদি দেহি কেউ কিছু কিনতাছে, সেই খানে গিয়া কই, “স্যার, কিছু কিইন্যা দেন, খামু।” তহন তারা নিজেরা একটু খাইয়্যা, বাকিটা আমারে দিয়া দেয়। আবার কেউ নতুন একটা কিইন্যা দেয়।’
আর রাতের খাবার? প্রশ্ন শুনে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। এবার সফিক বলে, ‘টিএসসিতে মাঝেমইধ্যে বিরানি খাওয়ায়। অনুষ্ঠান শেষ হইলে আমরা যাই। তারপর সেখানে মাইনষের প্লেটের বিরানি আর হাড্ডি খাই।’
এবার সজীব বলে, ‘গত শুক্কুরবার আমি বিরানি আর ম্যালা হাড্ডি পাইছিলাম। তিন ভাই পেট ভইর্যা খাইছি।’
আর যেদিন কোনো অনুষ্ঠান হয় না, সেদিন কোথায় খাও?
এবারও উত্তরটা সজীবই দেয়, ‘তহন মা ২৫ টেকার ভাত কিনে। মা আর আমরা তিন ভাই খাই। ভাতের লগে তরকারিও দেয়।’
‘আমারে একবার এক আপায় চকলেট দুধ কিইন্যা দিছিল। খুব মজা লাগছিল। এখন খালি হেই দুধ খাইতে মন চায়।’
একটু দূরে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। ওদের কারোরই এখন আর কথা বলার ফুরসত নেই। আইসক্রিমটা খেতেই হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফুল বেচে খুশি, রিমন আর ইয়াসিন। এদের মধ্যে রিমন আর ইয়াসিন ইসলামবাগে থাকে। সকালে কী খেয়েছ? রিমনের সহজাত উত্তর, ‘ক্রিম রুটি খাইছি। আর দুপুরে ফুচকা খাইছি প্যাট ভইর্যা।’
তাহলে ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে কী করো? এবার উত্তর দেয় ইয়াসিন। ‘মারে দিয়া দিই। মা হেই টেকা দিয়া সংসার চালায়। আমগোরে সকালে খাওনের টেকা দেয়। ঘরভাড়া দেয়। আবার মাঝেমইধ্যে রাইতে খাওনের টেকাও তো মায় দেয়।’ প্রতিদিন কত টাকার ফুল বিক্রি হয়?
‘৫০ টেকা, কোনোদিন ১০০ টেকা। ১৬ ডিসেম্বর আর এমন বড় বড় অনুষ্ঠান আইলে আরও বেশি বেচতে পারি।’
পাশেই মাটিতে বসে আছে খুশি। নখ দিয়ে গোলাপের কাঁটা ছাড়াতে ব্যস্ত। প্রশ্ন করি, তুমি দুপুরে কী খেয়েছ?
‘আমি আর আমার বইনে ভুনা খিচুড়ি খাইছি। এক আপায় খাইতাছিল। আমি চাইছি। তারপর এইটুকু দিছিল।’ দুই হাতে যতটুকু খাবার দেখাল, তাতে হয়তো ওর একারই পেট ভরার কথা নয়। সেটাই দুজন ভাগ করে খেয়েছে।
ওদের মতো ছিন্নমূল শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কতটুকু শর্করা, আমিষ, স্নেহজাতীয় পদার্থ দরকার, তা ওরা জানে না। কারণ, এগুলো ছাড়াই ওরা প্রতিদিন অন্যের আধা খাওয়া খাবার খায়। আর বেড়ে ওঠে অপুষ্টি নিয়ে।একটি শিশুর কতটুকু খাবার প্রয়োজন? আর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টি দরকার কতটুকু? এ বিষয়ে কথা বলি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাহমীনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসলে সব শিশুর জন্যই সমান পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন। প্রতিদিন এক কেজি ওজনের শিশুর জন্য দরকার ১০০ কিলোক্যালরি। সেভাবে ১০ কেজি ওজনের শিশুর জন্য ১০০০ কিলোক্যালরি। তবে শুধু ভাত বা ডাল খেয়ে যদি প্রয়োজনীয় ক্যালরি গ্রহণ করে, তাতে পুষ্টি সম্পূর্ণ হবে না। সে ক্ষেত্রে সুষম উপায়ে আমিষ, চর্বি ও শর্করা-জাতীয় খাবার খেতে হবে। সেই সঙ্গে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ-সবল রাখার জন্য মিনারেল ও ভিটামিন-জাতীয় খাবারও দিতে হবে।’ প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment