আমন, আউশ, বোরো—কোনো ফসলেই ফলনের কমতি নেই। গত বছরের তুলনায় ফলন বেড়েছে। আলু, সবজি ও পাটের ফলনও ভালো। উৎপাদন ভালো হওয়ায় এ বছর চাল আমদানি করতে হয়নি। ফলে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় অর্থের সাশ্রয় হয়েছে। কিন্তু এই সাশ্রয়ের সুফল কৃষক পাননি, পেয়েছে ভোক্তারা। অর্থাৎ ভোক্তারা তুলনামূলক কম দামে চাল খেয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে চালের দর কমেছে ১২ শতাংশ। সরু চালের দাম কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। গত বছর প্রতি কেজি চাল ৩২ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ বছর বিক্রি হয়েছে ২৮ থেকে ৩২ টাকা দরে। প্রধান আট ধরনের খাদ্যপণ্যের মধ্যে একমাত্র ধান-চালের দামই কমেছে।
উল্টোভাবে দেখলে কৃষক গত বছরের তুলনায় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ কম দর পেয়েছেন। গত বছরও কৃষক ধান বেচে উৎপাদন খরচ তুলতে পারেননি। প্রতি মণ ধান তাঁরা উৎপাদন খরচেরও কম দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। পাট বিক্রি করে কোনোমতে উৎপাদন খরচ উঠলেও এবার আলুর ফলন ও দাম দুটোই ভালো পেয়েছেন কৃষক।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আছে, ‘সবার জন্য খাদ্য’ নিশ্চিত করা হবে। ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পুনরায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। কৃষি উপকরণে ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা ও কৃষিঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তি সহজীকরণ হবে। সেচসুবিধা সম্প্রসারণ ও সুলভ করা হবে, ফসল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফসল ও সব কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার ১৪ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকার তিন ধরনের সারের দাম এক দফায় কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ৮০ টাকা থেকে ৪০ টাকা, মিউরেট অব পটাস (এমওপি) ৭৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৩৫ ও ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট ৮৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৪৫ টাকা কমানো হয়। পরে এই তিন ধরনের সারের দাম আরেক দফা কমিয়ে ২২, ১৫ ও ২৬ টাকায় আনা হয়। কিন্তু ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়ে ১২ টাকা থেকে ২০ টাকা করা হয়।
ক্ষমতায় আসার শুরুতে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। প্রথম বছর থেকে চালের দাম কমতে কমতে ৩০ টাকার নিচে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু চালের দাম কমলেও কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বিষয়টি আড়ালেই রয়ে যায়। এই সময়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়লেও ফসলের দাম না বেড়ে বরং কমেছে।
সেচকাজে জ্বালানি হিসেবে বছরে ২০ লাখ টন ডিজেল ব্যবহূত হয়। বর্তমান সরকারের চার বছরে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৬১ টাকা করা হয়েছে। কৃষি মজুরিও ২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অর্থনীতিবিদদের মতে, সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদনে খরচ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
অন্যদিকে ২০০৮-৯ সালে কৃষি খাতে ভতুর্কি এর আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়িয়ে চার হাজার ২৮৫ কোটি টাকা করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে চার হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ছয় হাজার ৯৫২ কোটি টাকা এবং চলতি অর্থবছরে তা বাড়িয়ে সাত হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেনের মতে, ২০১২ সালটি সরকার ও ভোক্তাদের জন্য তৃপ্তিদায়ক। কারণ, দাম ছিল কম। তবে মাঝারি ও বড় কৃষকের জন্য খারাপ সময়ই গেছে। উদ্বৃত্ত উৎপাদন করেও খাদ্য বিভাগের সংগ্রহের গতি ছিল ধীর। সরকার চাল রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সাহস দেখাতে না পারায় ধান-চালের দাম বাড়েনি। পাট রপ্তানির ক্ষেত্রেও নতুন আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে না পারায় পাটেরও ভালো দাম পাননি চাষি। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষিপণ্যের দাম বাড়ানোর যে সাহসী সিদ্ধান্ত দরকার ছিল, তা দেখা যায়নি।
কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি কমছে: পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরে কৃষকের আয় বৃদ্ধির হার অর্ধেক কমে গেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ শতাংশ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে হয় ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে আরও কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১২ সালের মুদ্রানীতিবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষি খাতের এই প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, কৃষি উৎপাদনের গতি গত বছরের মতো এ বছরও ঊর্ধ্বমুখীই ছিল। এ বছর বোরো, আমন ও আউশ মিলিয়ে চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় তিন লাখ টন বেড়ে তিন কোটি ৩৮ লাখ টন হয়েছে। বছরের পুরো সময়ে বৃষ্টিপাত উৎপাদন বাড়াতে অনুকূল ছিল। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়নি। সার, বীজ ও পানির তেমন সংকটের কথাও শোনা যায়নি।
খাদ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। এতে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে চালের প্রকৃত মূল্য ৫০ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে ডাল, মাংস, দুধ, সবজির মতো প্রধান পুষ্টিকর খাবারগুলোর দাম ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু গরিব মানুষের আয় সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে মানুষ অনেক বেশি ভাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর পুষ্টির ঘাটতি বাড়ছে। তবে গত ১০ বছরে মাছের প্রকৃত মূল্য কমতে শুরু করেছে।
ইফপ্রির বাংলাদেশের প্রধান আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, গত ৩০ বছরে ধানের যে উৎপাদন বেড়েছে, এর ৮৬ শতাংশ এসেছে উন্নত জাতের চাষ করায় একরপ্রতি ফলন বাড়ার মাধ্যমে। আর বাকি ১৬ শতাংশ জমির পরিমাণ বাড়ায় উৎপাদন বেড়েছে। ২০১২ সালেও এ পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এটা প্রমাণ করে যে পুষ্টিকর খাদ্যশস্যের গবেষণাকাজে সরকারের বেশি বিনিয়োগ করা উচিত।
উদ্বৃত্ত চাল নিয়ে বিপদ: খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (এফপিএমইউ) বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মাথাপিছু চালের ভোগ বছরে ১৬০ কেজি। জনসংখ্যা ১৫ কোটির চেয়ে কিছুটা বেশি ধরে হিসাব করলে এতে বছরে দেশে চালের চাহিদা দাঁড়ায় দুই কোটি ৮০ লাখ টন। বীজ, গবাদিপশু ও মুরগির খাদ্য বাবদ বাদ দিলে প্রায় তিন কোটি টন চাল মানুষের খাদ্য হিসেবে থাকে। ফলে প্রায় ২০ লাখ টন চাল এ বছর উদ্বৃত্ত ছিল।
তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি বছর মোট পাঁচ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত ও ২০ লাখ টন গমের ঘাটতি ছিল। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে গম আমদানি করা হলেও উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই বাড়তি চাল বাজারে থাকায় দাম ক্রমাগত কমছে।
কৃষকের মুনাফা কোথায় যাচ্ছে: এ বছর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইফপ্রি ভারত, চীন ও বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যের ওপর যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, এই তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষকেরা সবচেয়ে কম দাম পান। এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশের বাজারে ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতির প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে।
‘দ্য কোয়াইট রেভ্যুলেশন ইন স্টেপল ফুড ভ্যালু চেইন’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬২ শতাংশ চালকল ধান কেনে ফড়িয়াদের কাছ থেকে। আর ভারতের ৬৮ শতাংশ চালকল কৃষক ও কৃষক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে ধান কেনে। চীনে ৮৩ শতাংশ চালকল সরাসরি কেনে কৃষকের কাছ থেকে।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ভোক্তারা যে দামে চাল কিনে, এর ৩০ শতাংশ চলে যায় চালকলের মালিক, ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের হাতে। কৃষক পান ৭০ শতাংশ। গত এক বছরে চালের বাজার ক্রমে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যাচ্ছে। আর ধান-চালের দাম ১২ থেকে ১৩ শতাংশ কমে যাওয়ায় কৃষকের প্রকৃত আয়ও কমেছে। ইফতেখার মাহমুদ প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment