রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী, এ সফরকে অত্যন্ত সফল বলে প্রচার করছে বিএনপি। এদিকে এতকালের ভারত-বন্ধু একমাত্র দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ শিবিরে, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার ভাষায়, ‘নার্ভাসনেস’ দেখা দিয়েছে। তাঁরা কেউ কেউ এ সফরকে গুরুত্বহীন ও ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য নানা কথা বলছেন।
বিএনপি যদি আন্তরিকভাবে তাদের নীতিতে পরিবর্তন ঘটায় এবং তা যদি কেবল ভারতের স্বার্থরক্ষায় সীমিত না থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অন্যান্য স্বার্থরক্ষায় কার্যকর হয়, তবে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির লাভ হবে। কারণ, বিএনপির এ পরিবর্তনকে, একটু লঘুচালে বলা যেতে পারে—এ হলো বিএনপির আওয়ামীকরণ। তাতে তো আওয়ামী লীগের খুশি হওয়ারই কথা, অবশেষে তাদের অনুসৃত নীতি মানতে বিএনপি বাধ্য হচ্ছে। তাতে তাদের নীতিই যে ঠিক ছিল এবং তারাই অনুসরণীয় রাজনীতি করে এসেছে, সেটাই তো প্রমাণিত হয়।
আমরা দেখেছি ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা উড়িয়ে অনেক দাঙ্গাহাঙ্গামার পটভূমিতে ভারতীয় জনতা পার্টি যখন দিল্লির ক্ষমতায় এসেছিল এবং যখন এককালের জনসংঘ নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী ও রামমন্দির আন্দোলনের পুরোধা লালকৃষ্ণ আদভানি উপপ্রধানমন্ত্রী, তখন কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বাইরে গিয়ে কিছু করা তাদের জন্য দুষ্কর ছিল। তারা পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা ব্যাপক সমর্থন পায়নি, স্থায়ীও হয়নি। বাংলাদেশে বিষয়টা ছিল বিপরীত। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে, তারা প্রকৃত মুসলমানদের দল। আওয়ামী লীগ বরাবরই মুসলিমপ্রধান দল এবং ধর্মবিশ্বাসী ও ধর্ম পালনকারীদেরই দল ছিল। কিন্তু দলটি গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছিল। তারা দেশের সব সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলত, একসময় সমাজতন্ত্রের কথাও বলেছে। তদুপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী ভারতের ব্যাপক সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তাদের সঙ্গে ভারত সরকার, বিশেষত কংগ্রেস দলের ভালো সখ্য গড়ে উঠেছিল। এই সমঝোতাকে তারা রাজনীতিতে বরাবর মর্যাদা দিয়েও এসেছে। ফলে ভারতের সঙ্গে আস্থা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে আওয়ামী লীগের। এ কারণেই এতকাল বিএনপি ও মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলো নির্বাচনী রাজনীতিতে ঘায়েল করার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বরাবর ইসলামবিরোধিতা ও ভারতপ্রীতির অভিযোগ এনেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদ থেকে উলুধ্বনি হবে, এমনকি নামাজ পড়া যাবে না এমন অপপ্রচারণাও নির্বাচনের সময় শোনা যায়। পার্বত্য চুক্তির পর খালেদা জিয়া এমন কথাও বলেছিলেন যে, দেশের ওই অংশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। ফেনী থেকে চট্টগ্রামে যেতে পাসপোর্ট লাগবে। ভারতের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি হলেই তারা বলত, দেশকে ভারতের করদ রাজ্য বানানোর গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপির এ রাজনীতি একেবারে বিফলে যায়নি। দু-দুবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনে তাদের এ রাজনীতির কিছু ভূমিকা তো মানতেই হবে।
ইসলাম নিয়ে রাজনীতির ফল বিএনপি একচেটিয়া ভোগ করে যাবে, সেটা মুসলিমপ্রধান ও ধর্মপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কেন হতে দেবে। তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এল। দল বেঁধে মসজিদে যাওয়া, সভা মুলতবি রেখে জামাতে নামাজ আদায়, হজ করা ও নামের আগে আলহাজ ব্যবহার, টুপি মাথায় দেওয়ার পাশাপাশি অনেকে দাড়ি রাখতেও শুরু করলেন। এসব কিন্তু ভান নয়, তাঁরা আগেও ধার্মিক ছিলেন, কেবল তা প্রকাশ্যে এতটা লোক দেখিয়ে জাহির করতেন না। আজ অবস্থা এমন হয়েছে যে যাঁরা রাজনীতিতে প্রকৃত সেক্যুলার প্ল্যাটফর্ম খোঁজেন, যাঁরা রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে চান, তাঁরা একটু হতাশই হয়ে পড়েছেন। রাজনীতির মাঠে প্রকৃত সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দল আজ কোথায়?
এ কথা ভাবলে দোষ দেওয়া যাবে না যে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় পীড়নের শিকার হয়ে এবং ক্ষমতার বাইরে থাকতে বাধ্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ বিএনপি, এমনকি জামায়াতের রাজনৈতিক কালচারকে গ্রহণ করে ফেলেছে। ফলে একে সীমিত পরিসরে আওয়ামী লীগের বিএনপিকরণ (কট্টরপন্থীরা বলবেন জামায়াতীকরণ) বলতে চাইবেন অনেকে।
কথাটা কিন্তু একদম ফেলনা নয়। ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্তে যেসব পরিবর্তন ঘটে, তার প্রভাব ক্ষমতাকেন্দ্রে কিছু তো পড়েই, কিন্তু বৃহত্তর সমাজে তা পড়ে আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে। আজকে আমরা যদি দেশের গ্রামসমাজের এবং মফস্বলের দিকে তাকাই, তা হলে দেখব, গ্রামগুলো সাংস্কৃতিকভাবে নির্জীব হয়ে পড়েছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ এবং বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কথা বলা যাবে। কিন্তু তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মব্যবসায়ীর তৎপরতা। তারা সুপরিকল্পিত কর্মতৎপরতা চালিয়ে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক জীবনকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। যে গ্রামে আগে বছরে পাঁচটি নাটক হতো, যাত্রা হতো, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সেখানে এখন ওয়াজ নসিহত ছাড়া কিছুই হয় না। স্কুল-কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী নিয়ে অনেক হইচই হলো, কিন্তু সবই ঢাকা ও দু-একটি শহরে গণ্ডিবদ্ধ। অতীতে স্কুল-কলেজে যে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী হতো, এখন সেসব স্মৃতি। ফলে আমাদের অজান্তে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বড় দল আওয়ামী লীগের ঔদাসীন্যে সমাজের বিএনপি-জামায়াতীকরণের কাজ কিন্তু অনেক দূর হয়ে গেছে। এতে ইসলামের লাভ হয়নি, বাংলাদেশের তো নয়ই।
দেশে সাম্প্রতিক কালে সাম্প্রদায়িক যেসব হামলা, লুণ্ঠন, ধ্বংসের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, তা প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী নেতারা বিশেষ ভূমিকা নেন না, আর কর্মীদের কেউ কেউ তো অপকর্মে যুক্ত হয়ে যান। বর্তমানে বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার প্রতিপত্তি বেড়েছে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে মার্কিনবান্ধব ভারতের প্রভাব বাড়ছে। ভারত বিএনপির কাছে যা চায়, তাতে আমেরিকার সমর্থন আছে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানের অন্তরে যা-ই থাক, প্রকাশ্যে বিএনপির এই পরিবর্তন তাদের মানতে হবে।
তবে বিএনপিতে আশ্রয় নেওয়া দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী রাজনীতিকেরা এখন কী বলবেন। ভারত সফরের পটভূমিতে বিএনপি যদি তার প্রচারণার কৌশল বদলে প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইসলাম গেল ও ভারতপ্রীতির প্রচারণা চালাতে না পারে, জামায়াতকে সঙ্গে রাখতে না পারে, তা হলে তার হাতে ধারালো অস্ত্র আর কী থাকে? দলের এই অংশ নেহাত ছোট নয়, সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যেও এরা সংখ্যায় বেশি। এদের খালেদা জিয়া কী জবাব দেন, কী ব্যাখ্যা দেন বা কীভাবে সামলান, সেটাই হবে এখন দেখার বিষয়। আমার মতো মানুষের পক্ষে সহজেই বলা সম্ভব, বিএনপি সামনে চলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাকে নিয়েই এগোলে দেশ ও বিএনপির উপকার হবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ কোনোকালেই এ যুদ্ধ এবং এর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে পারবে না। এত মানুষ যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন, দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, অপরিসীম কষ্ট ভোগ করেছেন যে আওয়ামী লীগ হাল ছাড়লে বা ঢিলে দিলেও তাঁরা দেবেন না। বাংলাদেশের সরকারি দল, বিরোধী দল—সবারই আদর্শিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। এটা ন্যূনতম চাহিদা।
ধর্ম ও ভারত বাদ দিয়েও বর্তমান সরকারকে চেপে ধরার জন্য এত ইস্যু ছড়িয়ে আছে যে ইস্যুর জন্য বিএনপিকে হাতড়াতে হবে না। কিন্তু ইসলাম ও ভারত কার্ড নিয়ে খেলতে চাইলে মানুষ এখন বিরক্ত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ, মানুষ মাত্রই পেছনে যেতে চায় না। তারা চায় দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ প্রশাসনের এক সরকার। সেটা দিতে অতীতে যেমন বিএনপি পারেনি, তেমনি আওয়ামী লীগও পারছে না।
দুই দলই দুর্নীতি রোধে, দক্ষ সুশাসনের এবং অগ্রাধিকার কর্মসূচির প্রস্তাব নিয়ে মানুষের কাছে আসুক। দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত এক বাংলাদেশই আজ মানুষের স্বপ্ন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment