প্রথম শিক্ষা: সসম্মানে পরাজয় মেনে নেওয়া
আপনারা কি মিট রমনির ‘কনসেশন’ বক্তৃতা শুনেছেন? না শুনে থাকলে প্লিজ একবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ভদ্রলোক ৩০ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। সফল ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথমে ব্যবসায় পয়সা বানিয়েছেন, তারপর মাঝারি গোছের একটি অঙ্গরাজ্যে গভর্নর হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হতে যে ‘ক্রেডেনশিয়াল’ লাগে, ধীরে ধীরে তার সবই অর্জন করেছেন। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এ বছর তাঁর জেতার সম্ভাবনা অধিক—এ ব্যাপারে তাঁর সব উপদেষ্টা তাঁকে নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, আমেরিকার ইতিহাসে এ পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্ট ৭ দশমিক ২ শতাংশের ঊর্ধ্বে বেকারত্ব নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হতে পারেননি। ফলে বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। কার্ল রোভ, যাঁকে কেউ কেউ ‘বুশের দুষ্ট মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করে থাকেন তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন, তিন শতাংশ ভোটে তিনি জিতবেন। ইলেকটোরাল ভোটে তাঁর বিজয় হবে ‘ভূমিধস’।
রমনি নিজের বিজয় সম্বন্ধে এতটা স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে বোস্টন সমুদ্রপারে আট মিনিটের এক আতশবাজি উৎসবের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার পর কী ভাষণ দেবেন, তার খসড়াও অনুমোদন করেছিলেন। নিজের আইপ্যাডে মোট এক হাজার ১১৮ শব্দের ভাষণ সব সময় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। পরাজিত হবেন এমন কোনো ভাবনা মাথায় ছিল না, ফলে কনসেশন ভাষণ লেখার কোনো প্রয়োজনই দেখেননি।
অথচ মাঝরাত গড়ানোর আগেই টিভি নেটওয়ার্কগুলো জানিয়ে দিল—রমনি নন, জিতেছেন ওবামা। রাত ১১টা ১২ মিনিটে এনবিসি টিভি নেটওয়ার্ক থেকে সে ঘোষণা শোনামাত্র যেন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন রমনি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বোস্টনে তাঁর অপেক্ষমাণ সমর্থকদের সামনে এসে দাঁড়ালেন রমনি। এখন কী বলবেন তিনি? বিনা তর্কে তাঁর পরাজয় মেনে নেবেন, না সূক্ষ্ম কারচুপির নানা কুতর্ক জুড়ে দেবেন?
রমনি বললেন, ‘আমি অল্প কিছু সময় আগে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ফোন করে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছি। তাঁর সমর্থক ও নির্বাচনী প্রচার দলকেও আমার অভিনন্দন। আমি তাঁদের সবার মঙ্গল কামনা করি, বিশেষ করে মঙ্গল কামনা করি প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট লেডি ও তাঁদের দুই কন্যার। আমাদের সামনে এখন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমি প্রার্থনা করি, আমাদের দেশকে যেন প্রেসিডেন্ট সফলভাবে সামনে এগিয়ে নিতে পারেন।’
কোনো সন্দেহ নেই, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করতে রমনির হূদয় ভেঙে আসছিল, শুধু তীব্র মনের জোরে বাঁধভাঙা চোখের জল ঠেকিয়ে রাখছিলেন। মাত্র সাড়ে ছয় মিনিটের ভাষণ, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই, ক্রুদ্ধ প্রত্যাখ্যান নেই, বিজয়ী প্রতিপক্ষের প্রতি কোনো কটূক্তি নেই। রমনি আরও বললেন,
‘আপনারা জানেন, দেশ এখন এক জটিল ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। এখন দলীয় পক্ষপাতদুষ্টতা ও রাজনৈতিক ভাগাভাগি করার সময় নয়। আমাদের নেতাদের সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করার লক্ষ্যে হাত বাড়াতে হবে। এবং দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সময় দায়িত্বসম্পন্ন হতে হবে।...আমরা ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের কাছে আশা করি, তাঁরা রাজনীতির বদলে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। ...আপনাদের অনেকের মতো আমিও পল রায়ান (ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী) উভয়েই এ নির্বাচনে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলাম। জেতার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। আমার আশা ছিল, আপনাদের আশা পূরণ করে দেশকে নেতৃত্ব দেব, নতুন দিকনির্দেশনা দেব। কিন্তু দেশ একজন ভিন্ন নেতা নির্বাচিত করেছে। অতএব, আমি ও আমার স্ত্রী অ্যান আপনাদের সঙ্গে একযোগে তাঁর ও আমাদের এ মহান দেশের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছি।’
পরাজয় স্বীকার করে এমন একটি ভাষণ কি আমাদের কোনো জাতীয় নেতার কাছ থেকে কখনো আশা করতে পারি? কখনো কি এমন সম্ভব যে নির্বাচনী ফলাফলে পরাজিত সাব্যস্ত হওয়ার পরও কেউ হিংসায় নীল হবেন না, বিজয়ী প্রতিপক্ষের অমঙ্গল কামনা করবেন না, অথবা তাঁর প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়াবেন? গত ২২ বছরে বাংলাদেশে চারটি জাতীয় নির্বাচন দেখেছি, তার কোনো একটিতেও বিজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাননি, এক মুহূর্তের জন্য তাঁর সহযোগিতার হাত বাড়াননি অথবা রাজনীতির বদলে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করেননি। আমাদের রাজনীতিকেরা যদি মার্কিন নির্বাচন থেকে মাথা উঁচু করে বিনয়ের সঙ্গে পরাজয় মেনে নেওয়ার শুধু এ শিক্ষা গ্রহণ করেন, তা হলে আমাদের গণতন্ত্র তার শিশুকাল কাটিয়ে একফালে সাবালকত্ব অর্জন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
দ্বিতীয় শিক্ষা: অর্থ নয়, নির্বাচনে সাধারণ নাগরিকই একমাত্র প্রভু
২০১২ সালের নির্বাচনে সম্ভবত ছয় বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আড়াই বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। বুশের দুষ্ট মস্তিষ্ক তাঁর ‘রাজনৈতিক কমিটি’র মাধ্যমে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। ওবামাকে হারাতে দুই বিলিয়নিয়ার তেল ব্যবসায়ী চার্লস ও ডেভিড কোক, যাঁরা ওবামাকে যেকোনো মূল্যে পরাস্ত করা ‘আমেরিকার জীবন-মৃত্যুর লড়াই’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁরা সম্ভবত ৫০০ মিলিয়ন ডলার নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ব্যয় করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসবের কিছুই কাজে লাগল না, কারণ আমেরিকার ভোটার দেশের সাধারণ নাগরিক—তাঁদের নিজস্ব বিবেচনার ভিত্তিতে ভোট দিয়েছেন। ওবামার সঙ্গে রমনির প্রভেদ ছিল এখানে যে তাঁদের একজন দেশের মানুষের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, অন্যজন আস্থা স্থাপন করেছিলেন গোপন চক্রান্ত, টাকার শক্তি ও নির্বাচনী কারচুপির ওপর। রমনি তাঁর ধনী চাঁদাদাতাদের এক ভোজসভায় সরাসরিই বলেছিলেন, দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনা নেই। কারণ, এ ৪৭ শতাংশ মানুষ কখনোই তাঁকে সমর্থন করবেন না। ওবামা বলেছিলেন, ৪৭ শতাংশ নয়, দেশের ১০০ ভাগ মানুষের পক্ষে লড়বেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে আমরা আরও দেখলাম, শুধু অর্থ দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণিত হলে তবেই দেশের মানুষের মন জয় করা যায়। এবারের নির্বাচনে যাঁরা পরাস্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান লরা রিচার্ডসন, যিনি নির্বাচনী আইন খেলাপ করে সংগৃহীত চাঁদা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছিলেন। হেরেছেন ফ্লোরিডার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ডেভিড রিভেরা, যাঁর নামে অভিযোগ আছে সে রাজ্যের জুয়াখানার মালিকদের কাছ থেকে এক মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়েছেন। নেভাদার ডেমোক্রেটিক সিনেট প্রার্থী শেলি বার্কলি হেরেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্বামীর কিডনি ব্যবসায়ে দুর্নীতি ঢাকতে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়েছেন। ইলিনয়ের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জো ওয়ালশ তাঁর পরিত্যক্ত স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য নির্ধারিত ভাতা দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে পরাস্ত হয়েছেন। এ তালিকা আরও বাড়ানো যায়, কিন্তু মোদ্দা কথা আপনারা নিশ্চয় ধরতে পেরেছেন।
মার্কিন নির্বাচন থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শিক্ষণীয় হলো, নৈতিক প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ অথবা সরাসরি দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত এমন কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া ভুল। আর আমরা দেশের সাধারণ নাগরিকেরা এ শিক্ষা নিতে পারি, নির্বাচনী ফলের চূড়ান্ত চাবিকাঠি আমাদের হাতে।
তৃতীয় শিক্ষা: প্রতিটি প্রার্থী সব নাগরিকের কাছে প্রতিটি প্রশ্নে জবাবদিহি করতে বাধ্য
আমেরিকার নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচিত হয় দলীয় সমর্থক, সাধারণ নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে। ওবামা ও রমনি উভয়েই প্রাকিনর্বাচনী বাছাই পর্বে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ভোটারদের সামনে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, তারপর গোপন ব্যালটে প্রাকিনর্বাচনী বাছাই ভোটে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে যাঁর যাঁর দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। (পুনর্নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ওবামাকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়নি, কিন্তু চার বছর আগে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতে তবেই তিনি প্রার্থিতা অর্জন করেছিলেন)। শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নয়, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের জন্য প্রতিটি পদে প্রাকিনর্বাচনী বিজয়ী প্রার্থীরাই প্রতিনিধি পরিষদ বা সিনেটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মান পেয়েছেন।
তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর ওবামা ও মিট রমনি উভয়কেই সরাসরি বিতর্কে অংশ নিতে হয়েছে। সাধারণ নাগরিকেরা তাঁদের প্রশ্ন করেছেন, প্রার্থী হিসেবে তাঁদের কী যোগ্যতা, কী কারণে তাঁরা প্রেসিডেন্ট হতে চান, বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে তাঁদের কী অবস্থান। বিব্রতকর এমন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীনও তাঁদের হতে হয়েছে। লাইভ টেলিভিশনে তাঁদের প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কী করবেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করতে হয়েছে। শুধু প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নয়, সিনেট ও কংগ্রেস প্রার্থীদেরও একই জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়েছে, একাধিক বিতর্কে অংশ নিতে হয়েছে।
আমাদের দেশে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে তাঁদের পূর্বের অনুসৃত নীতি অথবা ভবিষ্যৎ নীতি বিষয়ে সরাসরি কোনো বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয় না। কোনো জবাবদিহি নেই, কোনো দায়বদ্ধতা নেই। প্রার্থী হতে হলে কয়েক বস্তা টাকা ও দলপ্রধানের সম্মতি থাকলেই যথেষ্ট। দলের প্রধানদেরও ভোটের আগ পর্যন্ত নাগরিকদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ইদানীং টিভিতে ভাষণের নিয়ম চালু হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে কারও লিখে দেওয়া ভাষণ পড়েই তাঁদের দায়িত্ব শেষ। প্রধান দলগুলোর প্রার্থীরা কোনো সময়ই মুখোমুখি কোনো বিতর্কে মিলিত হন না। সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি প্রশ্নোত্তরের তো কথাই উঠছে না।
কবে আমরা সাবালক হব?
১০ নভেম্বর ২০১২, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
0 comments:
Post a Comment