শায়েস্তা খাঁর সময় ট্রাক ছিল না। নৌকাতেই মালামাল পরিবহন করা হতো বেশি। কারণ, তখন নদীতে সারা বছর পানি থাকত। গরু-মহিষের গাড়িও মাল টানত। দুই-চার মণ মালের বস্তা ঘোড়ার পিঠে বহন করা হতো। তবে আড়াই মণ চাল-ডাল পোস্তগোলা থেকে চকবাজার নাজিমউদ্দিন রোড পর্যন্ত পিঠে বয়ে আনতে এক পয়সায় কোনো ঘোড়া রাজি হতো না। ঘোড়ার সহিস বস্তা পিঠে তুলে দিলেও ঘোড়া বেঁকে বসত।
শায়েস্তা খাঁর আমলের বাংলায় অনেক কিছুই ছিল না, এখন আছে। তখনো কিছু মানুষ অপরাধ করত। তাদের জন্য বন্দিশালা ছিল। তাঁর শাসনামলের বাংলা ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু বন্দিশালা ছিল কম। এখন আমাদের ৭৬টি কারাগার কয়েদিতে গিজগিজ করে। অন্তত ৭০ হাজার কয়েদি। তাদের খাইয়ে-পরিয়ে নাদুস-নুদুস রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না, যদি ‘কোটি কোটি টাকার পৈতৃক সম্পদ’ওয়ালা মহানুভব ঠিকাদারেরা এগিয়ে না আসতেন।
জানা গেল: ‘পোস্তগোলার সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে এক কুইন্টাল (১০০ কেজি) চাল, গম, চিনি বা লবণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনার ভাড়া এক পয়সা। এ হিসাবে প্রতি ১০ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া এক টাকা। এই ভাড়ার মধ্যে পণ্য ওঠানো-নামানোর খরচও আছে। [প্রথম আলো, ১.১১.১২]
এই খবর যদি শায়েস্তা খাঁর আমলের কোনো ঘোড়াকে শোনানো যেত, সে হ্রেষাধ্বনি দিয়ে বিকট শব্দে হেসে উঠত। তারপর এক পয়সা ভাড়ায় কোনো ঠিকাদার যদি তার পিঠে এক কুইন্টাল চালের বস্তা চাপিয়ে দিত, আমার বিশ্বাস, সে ওই ঠিকাদারকে সজোরে এক লাথি মারত।
গত অর্থবছরে কারাগারের জন্য খাদ্য পরিবহনের ঠিকাদারি পেয়েছে মেসার্স অমুক এন্টারপ্রাইজ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদক পণ্ডশ্রম করে জানতে পেরেছেন, ‘আসলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ঠিকাদারির অনুমতি পাওয়াটাই বড় কথা, দরদাম কোনো ব্যাপার নয়। যে পরিমাণ পণ্য কারাগারে সরবরাহ করার কথা, তার বেশির ভাগই মাঝপথে বেহাত হয়ে যায়।’ বেশির ভাগ যায়, আস্ত ট্রাক ঠাটারি বাজারে ঢুকে পড়ে না, কিছু মাল নাজিমউদ্দিন রোডেও পৌঁছে দেয়।
এক পয়সা দরে কার্যাদেশ দিয়েছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেলার ইসলাম সাহেব। জেলার সাহেব ও এন্টারপ্রাইজের মালিক মিলেমিশে রাষ্ট্রের খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এক টাকায় ১০ টনের ট্রাক ভাড়া পাওয়া যায় কি না—প্রতিবেদক জানতে চাইলে হাতেম তাইয়ের মতো মালিক বলেন, ‘আমি দিতে পারলে আপনার সমস্যা কী?’
অর্থাৎ প্রতিবেদক অনধিকার চর্চা করেছেন। শায়েস্তা খাঁর সময়ে দুদক নামক কোনো বস্তুও ছিল না। এখন যে ওই সংস্থা আছে, তা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দর্শকেরা প্রতিদিনই জানছেন। তবে থাকলেই বা কী? টিভি দর্শকেরা জানে, এক টাকায় ১০ টনি ট্রাক ভাড়া পাওয়া যায়—এ খবর শুনেও দুদক কর্মকর্তারা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো বুড়ো আঙুল চুষবেন। যদি কোনো চ্যানেলের রিপোর্টার মুখের কাছে বুম নিয়ে জানতে চায়, তিনি বলবেন, ‘ঠিকাদার দিতে পারলে আপনার সমস্যা কী? ওতে আমরা কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পাইনি।’
শুধু ট্রাকভাড়া নয়। বাংলার মাটির কোথাও ১২০ টাকা কেজির নিচে মসুরের ডাল নেই। ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক কেজি উন্নত মানের মসুরের ডাল সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৫৬ টাকা ৫৬ পয়সা করে। কাশিমপুর কারাগারে এ দর ৫৫ টাকা ৫৫ পয়সা।’ এতে প্রতিবেদক ভাবলেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। খাদ্যদ্রব্যের দাম এত পড়ে গেল কীভাবে, কারণ জানতে চাইলে ঠিকাদারের মুখপাত্র জানান, এন্টারপ্রাইজের মালিক মিয়া সাহেবের ‘কোটি কোটি টাকার পৈতৃক সম্পদ আছে। তিনি সেই টাকা থেকে ভর্তুকি দিচ্ছেন জেলখানার আসামিদের জন্য।’ জেলখানার কয়েদিদের কল্যাণ নিয়ে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছেন ভারতের কিরণ বেদি। ‘জেলখানার আসামিদের’ বন্ধু হিসেবে মিয়া সাহেবেরও পুরস্কার আসতে পারে ম্যানিলা বা অসলো থেকে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনাই অবিশ্বাস্য নয়। ভিনদেশি পাহাড় থেকে কোরবানির ঈদের আগে গড়িয়ে পড়ে গরু বাংলার মাটিতে। এ দেশে শাসকশ্রেণী চাইলে পাথর পর্যন্ত পানিতে ভাসাতে পারে। যে দেশে এক টাকায় ১০ টনি ট্রাক ভাড়া পাওয়া যায়, ঠিকাদার ১২০ টাকা কেজির ডাল সরবরাহ দেন ৫৫ টাকায়, সে দেশে ৬. ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে ঠিকাদার নির্বাচন থেকে সিমেন্ট কেনা পর্যন্ত দুর্নীতি হবে না—সে গ্যারান্টি কে দেবে?
বন্দীদের খাদ্যদ্রব্য চুরি করে কালোবাজারে বেচে দেওয়ার নাম ‘ভর্তুকি’ নয়। একটি রাষ্ট্রে যে কেউ যা খুশি তাই করতে পারে না—যদি তার ‘কোটি কোটি টাকার পৈতৃক সম্পদ’ থাকেও। কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর ও ধ্বংস হয় দুই ভাবে: বহিঃশত্রুর আক্রমণে অথবা দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও অপশাসনে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
prothom-alo
0 comments:
Post a Comment