আমার মা বাংলার শিক্ষক দেখেই আমাদের তিন বোনের নাম বাংলায় রেখেছে। আমার অপলা নামটি বড় মামার অনেক ভালো লাগত, তাই হয়তো তার বইয়ের চরিত্রের নাম দিয়েছে অপলা। এই নাম নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলেই আমি হাসিমুখে এই উত্তরটি দিই। সবাই ভাবে মজা করছি।
আমরা যখন ছোট তখন কিছু হলেই বড় মামা আমাদের সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যেত। কখনো গাড়ি কখনো বা বাসে আমরা যেতাম। গাড়িতে উঠলেই আমার বমি পেয়ে যেত। কখনো কখনো বমিও করে ফেলতাম। বড় মামা একদিন বের করল আমার ডাক নামটার জন্যই আমি বমি করি। ‘যেহেতু নাম অমি, তাই করি বমি!’ ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, বড় মামাকে কেউ দেখলেই ছবি তোলে, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমার তখন রীতিমতো হাসি পেত...ভাবতাম নিজের মামার আবার অটোগ্রাফ নেব কী, ছবি তোলারও বা কী আছে! আর আজ সেই আমি ব্যাকুল হয়ে খুঁজি বড় মামার সঙ্গে আমার একা কোনো ছবি আছে কি না...কই সব তো গ্রুপ ছবি! একটা ছবিও নেই কেন? বড় মামা যখন ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় মা তখন প্রায়ই জিজ্ঞাসা করত, ‘দাদা ভাই ভালো হয়ে যাবে, তাই না?’ প্রশ্নটার মাঝেই উত্তর থাকত। আমি তবু বলতাম, ‘বড় মামার ক্যানসারের চিকিৎসা সবচেয়ে দামি জায়গাতে হচ্ছে, বডি কেমোথেরাপি নিতে পারছে, কাজেই সুস্থ হয়ে আসবেই।’
বড় মামা যেদিন চলে গেল সেই ১৯ জুলাই রাতে, মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল: ‘তুমি না বলেছিলে দাদা ভাই ঠিক হয়ে যাবে?’ আচ্ছা, আমি এর উত্তরে কী বলব? আসলেই তো! কখনো ভুলেও যে মনে হয়নি বড় মামা
আর আসবে না...তা হলে এমন কেন হলো?
বড় মামার মরদেহ যেদিন দেশে আনা হলো, আমরা সবাই বারডেমে দেখতে গেলাম। হিমঘরে ট্রেতে কাফনের কাপড় পরা বড় মামা শুয়ে আছে। কী অবলীলায় আমি কাফনের কাপড় শব্দটা লিখলাম!
বড় মামার মুখটা খুলে দেওয়া হলো...আমার সেই বড় মামা!! পরিষ্কার, নিটল একটা মুখ। আমরা সবাই কাঁদছি। এত কষ্ট ঈশ্বর আমাদের জন্য রেখেছিল? আমরা সবাই ঘিরে বড় মামাকে দেখছি।
আমার মনে হলো, এখনই বড় মামা তাঁর স্বভাবমতো কপাল কুঁচকে বলে উঠবে, ‘কী হলো সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?’ কই এমন কিছু তো হলো না...কেন হলো না? নানু বড় মামার গালে গাল লাগিয়ে কাঁদছেন, শীলা আপু কপালে চুমু খাচ্ছে, মা, শাহীন মামা সবাই বড় মামার হাত-পা ছুঁয়ে দেখছে আর আমরা সবাই আমাদের প্রিয় মামাকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখছি...। আমি বড় মামার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। বিয়ের পর যখন বড় মামার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন করেছিলাম, আর সেদিন শেষ সালাম করলাম! এই শেষ আমাদের বড় মামার সঙ্গে দেখা? আর কোনোদিন বড় মামা আমাদের সবাইকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে না? আর কোনোদিন লটারি হবে না? আর কোনোদিন ঈদে ডাবল সালামি পেয়ে আমরা বিজয়ের হাসি হাসব না?...আচ্ছা এমন কেন হলো?
ও বড় মামা, আমরা যে প্রতিনিয়ত তোমাকে মিস করি তুমি বোঝ? নানু যে ড্রয়িংরুমের তোমার ছবি জড়িয়ে ধরে রোজ কাঁদে তুমি টের পাও? মা যে তোমার কথা সারা দিন মনে করে তা বুঝতে পার? এত তাড়াতাড়ি তুমি কেন চলে গেলে বড় মামা?
অপলা হায়দার: হুমায়ূন আহমেদের ভাগনি। প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment