১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাস আগে এই দিনটিতে তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার উৎখাত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ এবং সেনাবাহিনীর ভারতবিরোধী সম্ভাব্য অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই বৈঠকের অবমুক্ত করা গোপন নথি থেকে দেখা যায়, তাঁরা উভয়ে মুজিব সরকারের অবসান আসন্ন মনে করেছিলেন।
বাংলাদেশের একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামে ইয়াহিয়ার প্রতি নিক্সন-কিসিঞ্জারের সেই কুখ্যাত ‘ঝুঁকে পড়া’ নীতির ধারাবাহিকতায় পঁচাত্তরের ওই দিনগুলোতে ভুট্টো ও কিসিঞ্জার খুবই অন্তরঙ্গ সময় অতিক্রম করছিলেন। এমনকি অভ্যুত্থানের পর ভুট্টোর প্রশাসন আবেগে ভেসে গিয়ে বাংলাদেশের নাম পাল্টে ইসলামি প্রজাতন্ত্র করেছিলেন। যদিও তাতে খোন্দকার মোশতাক সরকারের প্রকাশ্য অনুমোদন ছিল না। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদদের বিষয়ে ভুট্টোর ভূমিকা আজও অনুদ্ঘাটিত। এই প্রতিবেদকের অব্যাহত গবেষণায় দেখা যায়, মোশতাক সরকারকে টিকিয়ে রাখা, খুনি চক্রকে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং এমনকি মুজিববিহীন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের তথাকথিত কনফেডারেশন গঠনে ফারুক রহমানের উদ্যোগ-সংক্রান্ত কিছু গোপন নথি রয়েছে। কিন্তু তা অবমুক্ত করা হচ্ছে না।
ভুট্টোর জীবনীকার মার্কিন অধ্যাপক স্টেনলি ওলপার্ট ১৯৯৩ সালে তাঁর জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান বইয়ে উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের কট্টর বামপন্থী নেতা আবদুল হক মুজিব সরকারকে উৎখাতে অস্ত্র ও বেতারযন্ত্রের সাহায্য চেয়ে ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভুট্টোর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। ভুট্টো সেই চিঠি পান ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি। তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। তবে ওলপার্টের বর্ণনায়, ভুট্টো সেই ‘অতি গোপনীয়’ চিঠির মার্জিনে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং এই ‘সৎ লোকটিকে’ ‘সাহায্য’ করতে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ভুট্টো আবদুল হককে ‘দারুণ কার্যকর’ ব্যক্তি বলেও অভিহিত করেন।
উল্লেখ্য যে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের আশঙ্কা এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ে বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন যে মুজিবকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। ওই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ ডেস্কে কর্মরত স্টিফেন আইজেনব্রাউন, যিনি পরে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসে পলিটিক্যাল কাউন্সেলর হয়ে এসেছিলেন, তিনি ২০০৫ সালে মার্কিন কথ্য ইতিহাসবিদ চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, মুজিবকে সতর্ক করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন যে ব্রিফিং তৈরি করেছিল, সেটা তিনি নিজ হাতেই করেছিলেন। তবে ঢাকায় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কে বা কখন বঙ্গবন্ধুকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তার নথিপত্র এখনো পাওয়া যায়নি। লরেন্স লিফশুলজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই সময় ঢাকায় কর্মরত সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি বলেছিলেন, ‘মুজিববিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা ছিল না।’ তবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান কাওকে মুজিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু ‘ওরা আমার সন্তানের মতো’ উল্লেখ করে তাঁর জীবনের প্রতি হুমকির আশঙ্কা অগ্রাহ্য করেছিলেন।
ব্লেয়ার হাউসের বৈঠক: পঁচাত্তরের ৫ ফেব্রুয়ারি কিসিঞ্জার-ভুট্টো প্রায় ঘণ্টাকাল বৈঠক করেন। এ সময় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমাদ, পররাষ্ট্রসচিব আগা শাহি, যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি জোসেফ জন সিসকো, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আলফ্রেড এল আথারটন, পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি এ বাইরোড উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার নোট নিয়েছিলেন পিটার ডি কনস্টেবল। এ দিনের আলোচনায় পাকিস্তান সফরে কিসিঞ্জার দম্পতির মধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁরা আলোচনার শুরুতেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কিসিঞ্জারের ভাষায়, ‘মিসেস কিসিঞ্জার পাকিস্তানের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন।’ এ সময় সিসকো বলেন, ‘মি. সেক্রেটারি প্রধানমন্ত্রী তো আপনাকে রাজকীয় সংবর্ধনা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ বলেছিলেন, ‘সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের চেয়ে অধিকতর জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা আপনারই প্রাপ্য।’ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এ দিন কিসিঞ্জারই তোলেন আগে।
কিসিঞ্জার: ‘মি. প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে আপনার জন্য বার্তা রয়েছে। তারা কোনো শর্ত ছাড়াই আপনার সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। আমাকে তারা এটা আপনাকে বলতে বলেছে।’
ভুট্টো: ‘ধন্যবাদ। আমি সহযোগিতা দিয়ে খুশি হব।’
কিসিঞ্জার: ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনে (বাকশাল) আপনি কি অবাক হয়েছেন?’
ভুট্টো: ‘না।’
কিসিঞ্জার: ‘আমার নিজের ধারণা, মুজিবের মেধা সরকার পরিচালনার চেয়ে বাগ্মিতায় নিহিত। ১৯৭১ সালে আমি পূর্বাভাস করেছিলাম যে বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক “বাস্কেট কেস” হবে।’
ভুট্টো: ‘বাংলাদেশ একটি দারিদ্র্য ও মহাকাব্য। মুজিব মহাকাব্য দিয়েছেন। তবে জনগণের দারিদ্র্য রয়েছে। কিন্তু তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।’
কিসিঞ্জার: ‘মুজিব কি টিকতে পারবেন?’
ভুট্টো: ‘আমি এতে সন্দেহ করি।’
কিসিঞ্জার: ‘তখন কী হবে? সেনাবাহিনী আসবে?’
ভুট্টো: ‘হ্যাঁ। এবং তখন তারা ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।’
কিসিঞ্জার: ‘গত অক্টোবরে আমার দক্ষিণ এশিয়া সফরের পরে আমার নীতিনির্ধারণী কমিটির প্রধান বলেন, ভারতকে দেখার পরে তার মনে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়কে পারমাণবিক অস্ত্র দেওয়া!’ (হাসি)
সিসকো: ‘আমি অন্য দিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীকে বলেছি, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হবে এক প্রাকৃতিক মিত্র।’
ভুট্টো: ‘আমরা যদি একটি কনফেডারেশন করতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো।’
আজিজ আহমাদ: ‘যদি তাদের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন থাকত।’
ভুট্টো এই আলোচনায় কিসিঞ্জারকে অবহিত করেন যে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায় এবং এ নিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা তাদের তা স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছি। দাউদের (আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি) ভাই নইম যখন পিকিং যাচ্ছিলেন এবং আমি মস্কো সফরে ছিলাম, সেই সময়ে চীনকে আমরা বলি যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সময়টা এখনো অনুকূল মনে হয়নি।
উল্লেখ্য, চুয়াত্তরের ২৯ অক্টোবরে কিসিঞ্জার ভারত সফরে ছিলেন। এ দিন তিনি সাউথ ব্লকের বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শরণ সিংকে বলেছিলেন, ভুট্টো তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। তবে তার আগে একটা সময় ভুট্টো অভ্যন্তরীণভাবে ভারতের সঙ্গে একটা বিরোধে যাবেন। এর পরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন, যেটা তিনি করেও ছিলেন। শরণ সিং এ সময় কিসিঞ্জারকে বলেন, ‘কিন্তু আপনার উচিত হবে না এ ধরনের নীতির প্রতি উৎসাহ জোগানো।’ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত টি এন কাউল এ সময় বলেন, ‘সিমলা চুক্তির পরে ভুট্টো বলেছিলেন যে বাংলাদেশকে তিনি দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বীকৃতি দেবেন।’ কিসিঞ্জার এ সময় বলেন ‘হাঁ’ অর্থাৎ তিনি এ বিষয়ে অবগত আছেন।
মার্কিন হাত নেই: ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বাইরোড ইসলামাবাদ থেকে কিসিঞ্জারকে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো গত রাতে তাঁকে ফোন করেন এবং আলাপ শুরুর প্রথম বাক্যটি ছিল তিনি (ভুট্টো) আগে থেকেই জানতেন যে আমরা (মার্কিনরা) বাজে লোকজন (ব্যাড গাইজ) নই। বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে আমাদের হাত ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের তেমনটাই মনে হতে পারে।’
জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে: ১৯৭৫ সালের ২৭ এপ্রিল মুজিব জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপসহকারী সেক্রেটারি ডাবস তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এ সময় অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ বণ্টনে বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যার বিষয়টি মি. ডাবসের কাছে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ভুট্টো বাংলাদেশের প্রতি একটা সদিচ্ছা দেখাবেন বলে আশা করি। আমরা শুনেছি যুগোস্লাভিয়ার কাছে তারা দুটি ৭০৭ বিমান বিক্রি করেছে। কিন্তু তা আমাদের দিয়ে দিলেই ভালো হতো।’
প্রেসিডেন্ট মুজিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এ সময় প্রত্যেকেই রাষ্ট্রদূত বোস্টার ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন বলে কিসিঞ্জার ওই বৈঠকসংক্রান্ত একটি বার্তায় উল্লেখ করেন।
জানা ছিল না: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অপরাহ্নে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ের জন্য একটি নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এসব প্রশ্নোত্তর বাস্তবে কোনো প্রেস ব্রিফিংয়ে উচ্চারিত হয়েছিল কি না, তা জানা যায় না। তবে কিসিঞ্জারের অনুমোদিত এই নীতিমালা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র কি কোনো আগাম হুঁশিয়ারি পেয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্র কি এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত? এর উত্তর লেখা আছে ‘গত রাতে ঘটনাবলি সম্পর্কে আমাদের কোনো আগাম সতর্কতা জানা ছিল না। তবে আমি এটা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারি যে আমরা এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’
আরেকটি গাইডলাইনে প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের নতুন সরকার কি পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনে যাচ্ছে? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের উত্তর ছিল: ‘আমরা এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারি না।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপত্র সে সময়ে যা বলতে পারেননি, সেই প্রশ্নের জবাব আজ ৩৭ বছর পরেও পুরোপুরি মিলেছে বলা যাবে না। এখনো পঁচাত্তরের রক্তাক্ত উপাখ্যানের অনেক কিছুই অবগুণ্ঠনে ঢাকা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment