বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানা শক্তিধর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ভূমিকায় নেমেছিলেন—এ কথাটি আমার প্রজন্মের অনেকেরই জানা। আমার প্রজন্ম বলতে যে বয়স-শ্রেণীর মানুষকে আমি চিহ্নিত করতে চাই, তাঁরা কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘দুঃসহ আঠারো’ বয়সে পা দিয়েছেন গত শতকের ষাটের দশকে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, রাজনীতি করেছেন এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর সামনে ছয় দফার রূপরেখাটি তুলে ধরলে তাঁরা তাঁর হাতেই তাঁদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তুলে দেন। এই নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন তাঁর দেশপ্রেম, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার জন্য।
১৯৬৬ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস ছিল শাসকদের শঠতা, নিষ্ঠুরতা এবং অবিমৃশ্যকারিতার। এই শাসকদের মোকাবিলা করে কোনো দাবি আদায় করা ছিল প্রায় অসম্ভব, যেহেতু শাসকদের প্রধান অংশটি ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল পুরো বাংলাদেশ। আজকের রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, নিরন্তর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত আত্মঘাতী বাঙালি সমাজের দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই ৪৩-৪৫ বছর আগেও স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশটি একটি পাহাড়ের মতো অবিচল ঐক্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঐক্য ভাঙার অনেক চেষ্টা পাকিস্তানিরা করেছে—তারা কিছু সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ এবং ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠীকে নানা প্রলোভনে হাত করে নিয়েছিল। কিন্তু মানুষের ঐক্যের সামনে তাতে কোনো কাজ হয়নি। মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরানোর অপপ্রয়াস সম্বন্ধেও আমরা জানতাম। এবং এ-ও জানতাম যে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে অনৈক্যের সব চেষ্টাকেই নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানতাম, তা কোনো বইপত্র পড়ে নয়, বরং নানা মানুষের লোক থেকে শুনে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর রাজনৈতিক সহচর ছিলেন, কেউ কেউ ছিলেন অনুসারী। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর সাহস নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন এক সাংবাদিক। তাঁকে নিয়ে আলতাফ গওহরের দু-একটি মন্তব্যও তখন মর্নিং নিউজ-এ পড়েছি। আর ১৯৬৬ সাল থেকে নিয়ে আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর অব্যাহতি পেয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁর কয়েকটি জনসভায় আমি উপস্থিত থেকেছি। এসব জনসভায় তিনি যখন বক্তৃতা করতেন, মনে হতো, ভয়-ডর কাকে বলে, তিনি তা জানেন না। খুব পরিষ্কার উচ্চারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের জানিয়ে দিতেন, তাদের অপচেষ্টা বাংলার মানুষ রুখে দেবেই। তাঁর প্রিয় একটি কথা ছিল, ‘জেলের ভয় দেখাবেন না।’ পাকিস্তানি শাসকেরা প্রায়শ বঙ্গবন্ধুকে জেলে নিয়ে যেত। বাংলাদেশের কোন জেলে তাঁকে নেওয়া হতো, তা-ও আমরা অনেক দিন পর্যন্ত জানতাম না। এক মেয়াদে জেল খেটে বেরোবার মুখে জেল গেটেই আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এ রকম ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু জেলে যাওয়াটা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সে জন্য যেন আমাদের কাছেও। দেশের জন্য, মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন, জেলে তো যেতেই হবে—এ রকম একটি যুক্তি তখন মাথায় নিয়েই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা রাজনীতি করতেন। এবং শুধু রাজনীতিবিদ নন, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী অথবা অজিত গুহর মতো বরেণ্য শিক্ষাবিদদেরও জেলে যেতে হয়েছে মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে দু-তিন বার খুব কাছে থেকে দেখেছি—প্রথম সেই ১৯৬৬ সালে, তখন তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগ্রহের জন্য সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং জনসভা করছেন, সে রকম এক সভা শেষে সিলেটে। তারপর দু-তিনবার ঢাকায়। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। কথা বলতে বলতে হাসতেন, রসিকতা করতেন, কিন্তু তাঁর কথাগুলো বলতেন একটা অটল বিশ্বাস থেকে। সেই বিশ্বাসের কেন্দ্রে ছিল মাটি ও মানুষ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এ দেশে আবার পাকিস্তানি ধারার শাসন ফিরে এল, পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আবার শরীর ধরে বাংলাদেশে নামল। আমাকে এদের এক বছরের মতো দেখতে হলো, তারপর বিদেশে গিয়ে পাঁচ বছরের জন্য বিরতি পেলাম। বিদেশের লাইব্রেরিতে মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু লেখালেখি চোখে পড়েছে। সেগুলো পড়েছি। পুরো কাগজ ঘেঁটে একাত্তরে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কী অভিঘাত ফেলেছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। স্পষ্ট মনে হয়েছে, সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে নামায় পশ্চিম বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পশ্চিম যে মানবাধিকার নিয়ে সব সময় চেঁচায়, তার পেছনে তাদের স্বার্থটাই প্রধান। তার পরও ফিচার এবং বিশেষ নিবন্ধগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটি এবং বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাসটি স্থান পেত। দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশের মানুষের সঙ্গে একটা স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আমার মনে হলো, প্রতিটি বছর যেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এই অপসৃত ইতিহাসের মিছিলে বঙ্গবন্ধুকেও ফেলে দেওয়া হলো। ফেলে দিল তৎকালীন সরকার, পাকিস্তানপন্থী কিছু ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী। কিন্তু কয়েক দশকের অপচেষ্টা এবং অবহেলার পরও একসময় বঙ্গবন্ধুর ঢেকে রাখা আসনটি উদ্ধার করা গেল। এবং সেটি করল দেশের মানুষই, বিশেষ করে তরুণ একটি প্রজন্ম, যারা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে একটা পাদটীকার অবস্থানে দেখে দেখে বড় হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অনেক জীবনী লেখা হয়েছে, তাঁকে নিয়ে অনেক স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি বাদে জীবনীগ্রন্থগুলোতে আছে শুধু স্তুতি আর প্রশংসা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনগড়া কাহিনি অথবা ঘটনার বর্ণনা। এ জন্য তাঁর জীবন নিয়ে লেখা কয়েকটি বই ছাড়া অন্য বইগুলো পড়তে কোনো আগ্রহ পাইনি। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর খণ্ডাংশ অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আক্ষেপ হলো, এ বইটি এত দিন পর কেন প্রকাশিত হলো। সেই ত্রিশের দশকের শেষ দিকে স্কুল ও কলেজের ছাত্র হিসেবে ছাত্ররাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রবেশ থেকে নিয়ে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিয়ে গভর্নরের শাসন জারি ও তাঁর আসন্ন গ্রেপ্তার পর্যন্ত সময়কালকে খণ্ড খণ্ড বর্ণনায় তিনি যে সারল্য ও নিপুণতার বর্ণনা করেছেন, তা থেকে তাঁর সংগ্রামের প্রেক্ষাপট, অনিবার্যতা এবং চালিকাশক্তি সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৬৯ সালে জেলে বসে তিনি পেছনে ফিরে গেছেন এবং তাঁর পরিবারের ইতিহাস থেকে নিয়ে সমকালীন রাজনীতিবিদ, রাজনীতির কূটচাল ও তাঁর নিজের আদর্শের কথাগুলো লিখেছেন।
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু, তাঁর প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে পুরো বইটিতে। কিন্তু সোহ্রাওয়ার্দী ভুল করলে তাঁর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিবাদ করেছেন। অগ্রজদের শ্রদ্ধা করেছেন। অনুজদের স্নেহ দিয়েছেন, সব বয়সীদের সমর্থন দিয়েছেন। আর বইজুড়ে আছে তাঁর সংগ্রামের নানা বর্ণনা। পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল ভূস্বামীদের হাতে এবং পরোক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করত সেনাপতিরা, যাদের বেশির ভাগও ওই ভূস্বামী পরিবারগুলো থেকে উঠে আসা। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন, সংগ্রাম করেছেন লোভের রাজনীতি, হঠকারিতার রাজনীতির বিরুদ্ধেও। একসময় পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক হলেও সেই ১৯৪৮ সালেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছে। এবং এরপর থেকে তাঁর সংগ্রাম ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সারা বইতে তাঁর আশাবাদ: তিনি বিজয়ী হবেন।
বিজয়ী তিনি হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেই যে পাকিস্তানের নষ্ট বীজ থেকে আবার গাছ জন্মাবে, সেসব গাছ পুষ্ট হবে, বাগান ঢেকে ফেলবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি। কিন্তু সেই বিষবৃক্ষ আবার এ দেশের মানুষ উপড়ে ফেলেছে আর তাঁর সাধের বাগানে সূর্যের আলো পড়েছে। ওই ফিরিয়ে আনার সংগ্রামটা মানুষ করছে তাঁর জন্যই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৬৬ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস ছিল শাসকদের শঠতা, নিষ্ঠুরতা এবং অবিমৃশ্যকারিতার। এই শাসকদের মোকাবিলা করে কোনো দাবি আদায় করা ছিল প্রায় অসম্ভব, যেহেতু শাসকদের প্রধান অংশটি ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল পুরো বাংলাদেশ। আজকের রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, নিরন্তর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত আত্মঘাতী বাঙালি সমাজের দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই ৪৩-৪৫ বছর আগেও স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশটি একটি পাহাড়ের মতো অবিচল ঐক্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঐক্য ভাঙার অনেক চেষ্টা পাকিস্তানিরা করেছে—তারা কিছু সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ এবং ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠীকে নানা প্রলোভনে হাত করে নিয়েছিল। কিন্তু মানুষের ঐক্যের সামনে তাতে কোনো কাজ হয়নি। মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরানোর অপপ্রয়াস সম্বন্ধেও আমরা জানতাম। এবং এ-ও জানতাম যে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে অনৈক্যের সব চেষ্টাকেই নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানতাম, তা কোনো বইপত্র পড়ে নয়, বরং নানা মানুষের লোক থেকে শুনে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর রাজনৈতিক সহচর ছিলেন, কেউ কেউ ছিলেন অনুসারী। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর সাহস নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন এক সাংবাদিক। তাঁকে নিয়ে আলতাফ গওহরের দু-একটি মন্তব্যও তখন মর্নিং নিউজ-এ পড়েছি। আর ১৯৬৬ সাল থেকে নিয়ে আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর অব্যাহতি পেয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁর কয়েকটি জনসভায় আমি উপস্থিত থেকেছি। এসব জনসভায় তিনি যখন বক্তৃতা করতেন, মনে হতো, ভয়-ডর কাকে বলে, তিনি তা জানেন না। খুব পরিষ্কার উচ্চারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের জানিয়ে দিতেন, তাদের অপচেষ্টা বাংলার মানুষ রুখে দেবেই। তাঁর প্রিয় একটি কথা ছিল, ‘জেলের ভয় দেখাবেন না।’ পাকিস্তানি শাসকেরা প্রায়শ বঙ্গবন্ধুকে জেলে নিয়ে যেত। বাংলাদেশের কোন জেলে তাঁকে নেওয়া হতো, তা-ও আমরা অনেক দিন পর্যন্ত জানতাম না। এক মেয়াদে জেল খেটে বেরোবার মুখে জেল গেটেই আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এ রকম ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু জেলে যাওয়াটা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সে জন্য যেন আমাদের কাছেও। দেশের জন্য, মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন, জেলে তো যেতেই হবে—এ রকম একটি যুক্তি তখন মাথায় নিয়েই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা রাজনীতি করতেন। এবং শুধু রাজনীতিবিদ নন, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী অথবা অজিত গুহর মতো বরেণ্য শিক্ষাবিদদেরও জেলে যেতে হয়েছে মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে দু-তিন বার খুব কাছে থেকে দেখেছি—প্রথম সেই ১৯৬৬ সালে, তখন তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগ্রহের জন্য সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং জনসভা করছেন, সে রকম এক সভা শেষে সিলেটে। তারপর দু-তিনবার ঢাকায়। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। কথা বলতে বলতে হাসতেন, রসিকতা করতেন, কিন্তু তাঁর কথাগুলো বলতেন একটা অটল বিশ্বাস থেকে। সেই বিশ্বাসের কেন্দ্রে ছিল মাটি ও মানুষ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এ দেশে আবার পাকিস্তানি ধারার শাসন ফিরে এল, পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আবার শরীর ধরে বাংলাদেশে নামল। আমাকে এদের এক বছরের মতো দেখতে হলো, তারপর বিদেশে গিয়ে পাঁচ বছরের জন্য বিরতি পেলাম। বিদেশের লাইব্রেরিতে মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু লেখালেখি চোখে পড়েছে। সেগুলো পড়েছি। পুরো কাগজ ঘেঁটে একাত্তরে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কী অভিঘাত ফেলেছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। স্পষ্ট মনে হয়েছে, সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে নামায় পশ্চিম বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পশ্চিম যে মানবাধিকার নিয়ে সব সময় চেঁচায়, তার পেছনে তাদের স্বার্থটাই প্রধান। তার পরও ফিচার এবং বিশেষ নিবন্ধগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটি এবং বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাসটি স্থান পেত। দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশের মানুষের সঙ্গে একটা স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আমার মনে হলো, প্রতিটি বছর যেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এই অপসৃত ইতিহাসের মিছিলে বঙ্গবন্ধুকেও ফেলে দেওয়া হলো। ফেলে দিল তৎকালীন সরকার, পাকিস্তানপন্থী কিছু ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী। কিন্তু কয়েক দশকের অপচেষ্টা এবং অবহেলার পরও একসময় বঙ্গবন্ধুর ঢেকে রাখা আসনটি উদ্ধার করা গেল। এবং সেটি করল দেশের মানুষই, বিশেষ করে তরুণ একটি প্রজন্ম, যারা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে একটা পাদটীকার অবস্থানে দেখে দেখে বড় হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অনেক জীবনী লেখা হয়েছে, তাঁকে নিয়ে অনেক স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি বাদে জীবনীগ্রন্থগুলোতে আছে শুধু স্তুতি আর প্রশংসা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনগড়া কাহিনি অথবা ঘটনার বর্ণনা। এ জন্য তাঁর জীবন নিয়ে লেখা কয়েকটি বই ছাড়া অন্য বইগুলো পড়তে কোনো আগ্রহ পাইনি। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর খণ্ডাংশ অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আক্ষেপ হলো, এ বইটি এত দিন পর কেন প্রকাশিত হলো। সেই ত্রিশের দশকের শেষ দিকে স্কুল ও কলেজের ছাত্র হিসেবে ছাত্ররাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রবেশ থেকে নিয়ে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিয়ে গভর্নরের শাসন জারি ও তাঁর আসন্ন গ্রেপ্তার পর্যন্ত সময়কালকে খণ্ড খণ্ড বর্ণনায় তিনি যে সারল্য ও নিপুণতার বর্ণনা করেছেন, তা থেকে তাঁর সংগ্রামের প্রেক্ষাপট, অনিবার্যতা এবং চালিকাশক্তি সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৬৯ সালে জেলে বসে তিনি পেছনে ফিরে গেছেন এবং তাঁর পরিবারের ইতিহাস থেকে নিয়ে সমকালীন রাজনীতিবিদ, রাজনীতির কূটচাল ও তাঁর নিজের আদর্শের কথাগুলো লিখেছেন।
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু, তাঁর প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে পুরো বইটিতে। কিন্তু সোহ্রাওয়ার্দী ভুল করলে তাঁর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিবাদ করেছেন। অগ্রজদের শ্রদ্ধা করেছেন। অনুজদের স্নেহ দিয়েছেন, সব বয়সীদের সমর্থন দিয়েছেন। আর বইজুড়ে আছে তাঁর সংগ্রামের নানা বর্ণনা। পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল ভূস্বামীদের হাতে এবং পরোক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করত সেনাপতিরা, যাদের বেশির ভাগও ওই ভূস্বামী পরিবারগুলো থেকে উঠে আসা। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন, সংগ্রাম করেছেন লোভের রাজনীতি, হঠকারিতার রাজনীতির বিরুদ্ধেও। একসময় পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক হলেও সেই ১৯৪৮ সালেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছে। এবং এরপর থেকে তাঁর সংগ্রাম ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সারা বইতে তাঁর আশাবাদ: তিনি বিজয়ী হবেন।
বিজয়ী তিনি হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেই যে পাকিস্তানের নষ্ট বীজ থেকে আবার গাছ জন্মাবে, সেসব গাছ পুষ্ট হবে, বাগান ঢেকে ফেলবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি। কিন্তু সেই বিষবৃক্ষ আবার এ দেশের মানুষ উপড়ে ফেলেছে আর তাঁর সাধের বাগানে সূর্যের আলো পড়েছে। ওই ফিরিয়ে আনার সংগ্রামটা মানুষ করছে তাঁর জন্যই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment