হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আমার যখন পরিচয়, তখন তিনি হুমায়ূন আহমেদ হওয়ার প্রথম ধাপে। অগ্রজপ্রতিম আহমদ ছফার কাছ থেকে জানতে পারলাম, অসাধারণ একজন গুণী লেখকের তিনি সন্ধান পেয়েছেন। ছফা ভাইয়ের ভাষায়, ‘এই ছেলে বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে।’ নতুন লেখককে নিয়ে ছফা ভাইয়ের উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। আমাকে সঙ্গে করে নিয়েই হাজির হলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফের বাসায়। স্যারের কাছে নন্দিত নরক-এর পাণ্ডুলিপি দিয়ে বললেন, এটি তাঁর পড়তে হবে এবং উপন্যাসটির একটি ভূমিকা লিখে দিতে হবে। শরীফ স্যার কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন, উপন্যাসের ভূমিকা কী লেখা হয়? ছফা ভাইয়ের স্বভাবসিদ্ধ উত্তর ছিল, ভূমিকা লেখা হোক বা না হোক, সেটা বিষয় নয়, বাংলা সাহিত্যের এই নব্য আবিষ্কৃত জ্যোতিষ্ককে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিরল সম্মানের সুযোগ তিনি যেন হাতছাড়া না করেন। যত দূর মনে পড়ে, স্নেহশীল শরীফ স্যার ছফা ভাইয়ের এই অনুরোধ রেখেছিলেন।
ওই সময়েই আমার পরিচয় ঘটে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে। স্বল্পভাষী তীক্ষ মেধাবী অথচ চরম হাস্যরসবোধসম্পন্ন এই ব্যক্তি আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেন। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছর বড়, তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে কার্জন হলে রসায়ন বিভাগের ল্যাবে প্রায়ই তাঁর কাছে আড্ডা দিতে চলে যেতাম। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু একই বিভাগের আতিক রহমান (বর্তমান বিশ্বখ্যাত পরিবেশকর্মী), হুমায়ূন ভাই ও আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি আমাদের নানা বিষয়ী আলাপচারিতায় রসায়ন বিভাগের গবেষণাগারের উৎকট গন্ধের মধ্যে।
এই আড্ডার একপর্যায়ে তিনজনই একমত হলাম, ঢাকা শহর ভালো লাগছে না। বাইরে যেতে হবে। কোথায় যাওয়া যেতে পারে, এ আন্দোলনের শুরুতেই আমি প্রস্তাব করলাম, আমার মামার বাড়ি ফরিদপুরের কথা। সঙ্গে সঙ্গে আতিক ভাই ও হুমায়ূন ভাই রাজি হলেন। পরদিনই আমরা রওনা হই দিন তিনেকের জন্য ফরিদপুর শহরের ময়েজ মঞ্জিল, আমার বাসার উদ্দেশে। সারা রাত আড্ডা হতো। কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন হুমায়ূন ভাই। ভূত-প্রেতের গল্প থেকে শুরু করে আইজ্যাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশনস, নানা বিষয় নিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে ছিলাম আমরা দুজন এবং আমার ছোট ছোট মামাতো ভাইবোনেরা। মাঝরাতের পর বসত হুমায়ূন ভাইয়ের ম্যাজিক দেখানোর আসর।
ফরিদপুর সফরের সাফল্যের পর হুমায়ূন ভাইয়ের ভাষায়, বঙ্গদর্শনের পরবর্তী পর্যায় আমরা তিনজন কিছুদিন পর যাই সিলেটে। ওই যাত্রার আয়োজনের দায়িত্ব হুমায়ূন ভাই নিজেই নিলেন। সিলেট পৌঁছে টের পেলাম হুমায়ূন ভাইয়ের যে বন্ধুর বাসায় আমাদের থাকার কথা, তাঁকে তিনি আগাম জানাতেই ভুলে গেছেন। বলা বাহুল্য, আড্ডায়, কবিতায়, গল্পে ও ম্যাজিকে দু-তিন দিন পরিপূর্ণ আনন্দের মধ্যে কেটেছিল।
একদিন তাঁর ল্যাবের আড্ডায় হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে আমার একটি সুপ্ত বাসনার কথা ব্যক্ত করলাম। একসঙ্গে অনেক ধরনের চাইনিজ স্যুপ খাওয়া। হুমায়ূন ভাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন বলাকার ওপরের চৈনিক রেস্তোরাঁয়। বললেন, ‘তোমার যা যা স্যুপ পছন্দ, তা অর্ডার দাও।’ নষ্ট হবে ভেবে আমি একটির বেশি দিতে চাইছিলাম না। নাছোড়বান্দা হুমায়ূন ভাই শর্ত দিলেন, ‘নষ্ট হলে হোক, নিদেনপক্ষে আমাকে তিনটি স্যুপ অর্ডার করতে হবে।’ সঙ্গে এই উপদেশও দিলেন, ‘ছোট ছোট সেসব শখ/সাধ একটু উদ্যোগ নিলেই পূরণ করা যায়। সেগুলো পূরণ করাটাই ভালো। অন্যথায়, আত্মার কষ্ট বাড়ে।’ অনুজদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এটি হয়তো সাধারণ ঘটনা, তবে আমার জন্য তা ছিল এক বড় প্রাপ্তি।
একদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকার প্যারিদাস রোডে খান ব্রাদার্সের দোকান হয়ে হুমায়ূন ভাই পাটুয়াটুলীর এক ছাপাখানায় নিয়ে যান। তাঁর সদ্য প্রকাশিত শঙ্খনীল কারাগার-এর বাঁধাই হওয়া প্রথম কপি তিনি হাতে তুলে নেন। তাঁর চোখ চিকচিক করছিল। আবেগে আপ্লুত হয়ে অনেকক্ষণ ধরে বইটির ঘ্রাণ শোঁকেন।
পিতা আবেগ-গৌরবে তাঁর সদ্যজাত শিশুকে কোলে তুলে নেয়, অপার স্নেহে তার দিকে তাকিয়ে থাকে—একই আবেগে হুমায়ূন তাঁর বইটি আগলে রেখেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। পরে আমাকেও আহ্বান জানান ওই ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য। এ কথা স্মরণ করে নিজেকে আজ সম্মানিত মনে করছি।
আরেক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিসে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। হাতে তাঁর একটি বই মেটে রঙের কাগজে মোড়ানো। জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন, তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই একজনকে ডাকে পাঠাচ্ছেন। উৎসাহ নিয়ে ঠিকানাটি দেখলাম—গন্তব্যস্থান ধানমন্ডি। আমি বললাম, ডাকে পাঠানোর প্রয়োজন কী, নিজে গিয়েই দিয়ে আসুন না, কেন? তিনি ব্যস্ত থাকলে আমি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি—আমার এই প্রস্তাবে তিনি হেসে বললেন, ‘তোমাকে পাঠানো ঠিক হবে না, মার খেতে পারো।’ তখন বুঝলাম, বইয়ের প্রাপকের সঙ্গে হুমায়ূন ভাইয়ের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বা তখনো ওই পক্ষের পরিবারের জানা ছিল না বা জানা থাকলেও সমর্থন ছিল না। আমি উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, বইটি যদি প্রাপক ছাড়া অন্য কারও হাতে পড়ে, তাহলে আমাকে যে ঝামেলা থেকে তিনি নিষ্কৃতি দিতে চাইছেন, প্রাপককেও যে সে ঝামেলায় পড়তে হবে, তা তিনি বিবেচনায় রেখেছেন কি না। উত্তরে হুমায়ূন জানালেন, ‘সে সামলে নিতে পারবে।’
তখন ছফা ভাইয়ের উদ্যোগে আমরা কয়েকজন বাংলাদেশ লেখক শিবিরকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সংগঠন করতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে মতপার্থক্য, বাক্যবিনিময় হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো একটি বিষয়ে আমার সঙ্গে ছফা ভাইয়ের ওই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর তৎকালীন নিবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে। এর দুই দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে রিকশা থামিয়ে হুমায়ূন ভাই আমাকে সাদামাটা ভাষায় জানিয়ে দেন, ছফা ভাইয়ের প্রতি আমার আচরণের জন্য এক বড় খেসারত আমাকে দিতে হচ্ছে। জানালেন, তখনই প্রেস থেকে তিনি আসছেন এবং আসার আগে তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ের উৎসর্গকৃতদের থেকে আমার নামটা কেটে দিয়ে এসেছেন। আমি জানতে চাইলাম, নাম যদি কেটেই দিলেন, তবে তা আমাকে জানাচ্ছেন কেন? উত্তরে জানালেন, ছফা ভাই সম্মানীয় ব্যক্তি এবং তাঁঁর সঙ্গে সংযত আচরণ না করলে তার মূল্য যে কত, সেটাই তিনি আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন। ছফা ভাইয়ের প্রতি হুমায়ূন ভাইয়ের এই পক্ষপাতিত্বে আমি অভ্যস্ত ছিলাম এবং অকপটে তাঁর একপেশে বিচার মেনে নিয়েছিলাম। অনেক পরে জেনেছি হুমায়ূন ভাই অন্যভাবে হলেও আমার নামটা তাঁর পরবর্তী কোনো উপন্যাসে স্থান দিয়েছিলেন। গ্যাদা মিয়ার ছেলের নাম কি আবরার চৌধুরী হবে?—এ ধরনের কোনো উক্তিতে।
আমি নিজেকে সাহিত্যানুরাগী হিসেবে কোনোভাবেই দাবি করতে পারি না। তাঁর সাহিত্যকর্মের মান বিচারিক কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। তবে এতটুকু বুঝি, হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের পাঠককে বাংলাদেশের বইমুখী হতে এক জাদুকরের ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্বায়নের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখেও বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের মানুষ হুমায়ূন ভাই তাঁর সৃজনশীলতাকে নানা ক্ষেত্রে প্রসারিত করেছেন। তাঁর অনেক সুনাম হয়েছে, বাংলা ভাষার প্রথিতযশা লেখকদের কাতারে তিনি নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন ও ব্যাপ্তি এবং তাঁর ব্যস্ততা আমাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েছে। বেশ কয়েক দশক ধরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না—যদিও আমরা একই শহরের বাসিন্দা। বিভিন্ন সময় মনে হয়েছে, পুরোনো সম্পর্কের রেশ ধরে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা আবার ঝালাই করে নিই। সেই সুযোগ আর হলো না।
সি আর আবরার: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।prothom-alo
0 comments:
Post a Comment