আজ মঙ্গলবার বাদ জোহর নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বেলা দুইটায় বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও চোখের জলে হুমায়ূন আহমেদকে খুব যতনে শুয়ে দেওয়া হয় নুহাশপল্লীর মাটির ঘরে। বাঁশ ও চাটাই দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় কবরের ওপরের অংশ। হুমায়ূন আহমেদের তিন ছেলে নুহাশ, নিষাদ ও নিনিত বাবার কবরে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মাটি। কবরের ওপর মুঠো ভরে মাটি ছড়িয়ে দিয়েছেন অন্য স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তরা। ধীরে ধীরে কবর ঢেকে যায় মাটিতে। মোনাজাত শেষে কবরের ওপর ফুল দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি জানানো হয় পরম ভালোবাসা।
অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়ে চন্দ্রকারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়ে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সে আকুতি কবুল হয়েছে। চিরদিনের জন্য তিনি চলে গেলেন চন্দ্রকারিগরের কাছে।
দিনভর সিদ্ধান্তহীনতার পর গতকাল সোমবার গভীর রাতে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রয়াত লেখককে নুহাশপল্লীতেই সমাহিত করা হবে। সে অনুযায়ী আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বারডেমের হিমঘর থেকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে নুহাশপল্লীর দিকে রওনা দেন তাঁর স্বজনেরা। দুপুর ১২টার দিকে নুহাশপল্লীতে পৌঁছায় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ।
হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ পৌঁছার আগেই নুহাশপল্লীতে যান তাঁর মেয়ে নোভা, শীলা ও ছেলে নুহাশ। লেখকের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীবসহ অন্যান্য স্বজন ছাড়াও সেখানে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আজ সকালে বৃষ্টি থাকায় লিচুবাগানের পাশে শামিয়ানা টানানো হয়। গ্রামের মানুষ সকাল থেকেই তাদের প্রিয় স্যারকে শ্রদ্ধা জানাতে নুহাশপল্লীতে জড়ো হয়।
নুহাশপল্লীতে ঢুকে মাঠ ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই হাতের বাঁ পাশে শেফালিগাছের ছায়ায় নামাজের ঘর। এর পাশেই তিনটি পুরোনো লিচুগাছ নিয়ে একটি ছোট্ট বাগান। লিচুবাগানের উত্তর পাশে জামবাগান আর দক্ষিণে আমবাগান। ওই লিচুবাগের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
জানা যায়, কথাচ্ছলে তাঁর সহকর্মীদের ওই জায়গাটির কথা বলতেন হুমায়ূন। নুহাশপল্লীর সহকারী ব্যবস্থাপক নুরুল হক বলেন, ‘আমাদের তিনি (হুমায়ূন আহমেদ) প্রায়ই ওই লিচুবাগানের কথা বলতেন, যেন মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানে কবর দেওয়া হয়।’
নুহাশপল্লীর প্রধান বাবুর্চি আবুল বাশার বলেন, ‘স্যার নুহাশপল্লীতে প্রবেশ করলেই সবার আগে খোঁজ নিতেন তাঁর প্রিয় গাছগাছালির। তিনি প্রায়ই ওই লিচুবাগানে ছুটে যেতেন। সব সামাজিক অনুষ্ঠান ওই লিচুগাছের নিচেই হয়ে আসছে।’
নুহাশপল্লীর ওই তিনটি লিচুগাছ এই উদ্যানের সবচেয়ে পুরোনো। উদ্যানটি গড়ার সময় প্রথম একটি খড় ও শণের ঘর ছিল ওই স্থানে। সেখানে লেখক প্রথম দিকে বসবাস করতেন। ওই স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার কথা লেখক তাঁর সহকর্মীদের বলেছেন।
নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘এই লিচুবাগান ছিল স্যারের খুব প্রিয়। তিনি প্রায়ই এখানে এসে বসতেন। লিচুবাগানের শীতল ছায়ায় প্রাণ জুড়াতেন। স্যার বলতেন, “আমি মারা গেলে ওই লিচুবাগানের নিচেই আমাকে রেখো।” স্যার আমাদের প্রায়ই ওই জায়গার কথা বলতেন।’
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নুহাশপল্লীতে দাফন উপলক্ষে নিরাপত্তার জন্য ২৫০ জন পুলিশ, র্যাব ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
গতকাল সোমবার সকাল থেকেই জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ছিল তাদের প্রিয় লেখকের সমাধি কোথায় হবে তা নিয়ে। সকালে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওনার (হুমায়ূন আহমেদ) শেষ ইচ্ছা ছিল নুহাশপল্লী। ওনাকে আর কষ্ট দিয়েন না। নুহাশপল্লীতেই ব্যবস্থা করেন।’ তবে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের অন্য সদস্যরা চেয়েছেন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী বা বনানী কবরস্থানে তাঁর দাফন হোক।
পরিবারের মধ্যে মতপার্থক্য অবসানে গতকাল রাতভর স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা কয়েক দফা দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পর গতকাল রাত আড়াইটার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বেরিয়ে হুমায়ূনের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, নুহাশপল্লীতেই দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘তাঁর (হুমায়ূন) সন্তানেরা মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করতে চাইলেও তারা এটাও চায়নি যে, তাদের বাবা বারডেমের হিমঘরে থাকুক। তারা যেকোনোভাবে তাঁকে মাটির নিচে ফিরিয়ে দিতে চায়। এ জন্য নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আর দেশের মানুষও যেন মনে না করতে পারে যে আমরা তাঁকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছি।’
জাফর ইকবাল আরও বলেন, ‘তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানেরা খুব করে চাচ্ছিল, তাঁকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে। তাহলে তারা সহজে যেতে পারত। দেশের মানুষও সহজে যেতে পারত। আমাদের মা-ও এটা চাচ্ছিলেন। আমরা দিনভর শাওনকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। বোঝাতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু বোঝাতে পারিনি।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জাফর ইকবালের সঙ্গে ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও পরিচালক শাইখ সিরাজ প্রমুখ।
নুহাশপল্লীতে দাফনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন হুমায়ূনের স্ত্রী শাওন। ধানমন্ডিতে লেখকের বাড়ি ‘দখিন হাওয়া’য় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ১২ তারিখ (জুলাই) সকাল পাঁচটায় অপারেশনে যাওয়ার আগে তিনি (হুমায়ূন) বলছিলেন, “আমি জানি আমি ভালো হয়ে যাব। তবে আমার যদি কিছু হয়, আমাকে নিয়ে ওরা অনেক টানাহেঁচড়া করবে, তুমি শক্ত থেকো, কুসুম। আমাকে নুহাশপল্লীতে নিয়ে যেয়ো”।’
এ বক্তব্যের কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকার কথা জানিয়ে শাওন বলেন, ‘কোনো স্ত্রী, কোনো আত্মীয়স্বজন অপারেশনের আগের দিন রাতে বলা কথা কি রেকর্ড করে রাখে?’
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পক্ষের পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে শাওন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় যারা হুমায়ূন আহমেদের পাশে দাঁড়ায়নি, পারিবারিক মিটিং করেনি, তাদের অধিকার নেই এখন মিটিং করার।’
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়। তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment