কুদ্দুস বয়াতি বলেন, ‘এটা ঠিক যে, অনেক আগে থেকেই আমি গান করি। তবে আমাকে আজও কেউ চিনত না যদি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে আমার দেখা না হতো। স্যারের হাতেই নেত্রকোনার কুদ্দুস থেকে কুদ্দুস বয়াতির জন্ম। আজ আমাকে যত মানুষ চেনেন, তা হুমায়ূন স্যারের জন্যই।’
শুধু কি কুদ্দুস বয়াতি? হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে ১৯৯৫ সালে ‘ওইজা বোর্ড ’ নামের একটি নাটকে ‘আইজ পাশা খেলব রে শাম’ গানটি দিয়ে রাতারাতি আলোচনায় উঠে আসেন কণ্ঠশিল্পী সেলিম চৌধুরী। সংগৃহীত গান দিয়ে আলোচনায় এলেও হুমায়ূন আহমেদের লেখা পাঁচটি গানে কণ্ঠ দিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়। তবে ১৯৯৪ সালে সিলেটে হাসন রাজা উত্সবে অতিথি হিসেবে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আজকে সবাই আমাকে যে হাসন রাজার গানের শিল্পী হিসেবে আলাদাভাবে চেনে, তার পুরো কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদ স্যারের। যত দূর জানি, এ পর্যন্ত ওনার লেখা চল্লিশটির মতো গান প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি গান করেছি আমি। এটা একজন শিল্পী হিসেবে আমার জন্য অনেক গর্ব ও সৌভাগ্যের।’
হুমায়ূন আহমেদের মৌলিক গানগুলোর বেশির ভাগেরই সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে তাঁর লেখা ৪০টির মতো গান প্রকাশিত হয়েছে। ৩৫টির মতো গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অডিও বাজারের প্রতি এক ধরনের অভিমান এবং নানা অনিয়মের কারণে সুর ও সংগীত পরিচালনা থেকে দূরে সরে ছিলাম। ২০০০ সালে “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে “এক যে ছিল সোনার কইন্যা” গানটির মধ্য দিয়ে আমার সুরের জগতে আবার আবির্ভাব। বলতে পারেন, এ গানটির মাধ্যমেই সংগীতজগতে আমার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। এই প্রত্যাবর্তনের পুরো কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদের। তিনি এ উদ্যোগ না নিলে আমার সংগীতজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হতো না। আর তাই সংগীতে আমাকে দ্বিতীয় জীবন দেওয়ার জন্য হুমায়ূন আহমেদের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।’
মকসুদ জামিল মিন্টু বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের গানের কথায় আধ্যাত্মিকতা ও জীবনবোধের নানা বিষয় চমত্কারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গীতিকবি হিসেবে তাঁকে শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ ও হাসন রাজার সমপর্যায়ের বলেই আমার মনে হয়।’
সংগীতজগতে অনেক দিন ধরে থাকলেও বারী সিদ্দিকীর নবউত্থান ঘটেছিল হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র আর টিভি নাটকে গান করে। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকটি সংগৃহীত গান গেয়ে দেশের মানুষের ভালোবাসা আর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বারী সিদ্দিকী। সংগৃহীত গান বেশ কয়েকটি করলেও হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি গান করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। ‘ওগো ভাবিজান’ শিরোনামে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন মকসুদ জামিল মিন্টু।
বারী সিদ্দিকী বলেন, ‘স্যার আমাকে ফকির থেকে রাজা বানিয়েছেন। সেদিন কী ভেবে স্যার আমাকে নিয়ে এত বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সে বিস্ময় আজও আমার কাটেনি।’ বারী সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘গান সম্পর্কে স্যারের যে জ্ঞান, প্রেম ও সাধনা ছিল, তার কানাকড়িও আমার মধ্যে ধারণ করতে পারিনি।’
বর্তমান প্রজন্মের সংগীতপরিচালক ইমন সাহাও হুমায়ূন আহমেদের দুটি মৌলিক গানের সংগীত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন। এ জন্য ইমন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। তিনি বলেন, ‘দেড় শর মতো বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এত ছবিতে কাজ করার পরও মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিল, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করা হয়নি! এর মধ্যে একদিন জানতে পারলাম, হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি গান ফেরদৌস ভাইয়ের (চিত্রনায়ক ফেরদৌস) চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হবে। ফেরদৌস ভাই জানালেন গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করতে হবে আমাকে। এ যে আমার জন্য কী আনন্দের বিষয় ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। অবশ্য এরপর হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত “ঘেঁটুপুত্র কমলা” ছবির আবহসংগীতের কাজটিও করি। এ ছবির কাজের ব্যাপারে অভিনয়শিল্পী প্রাণ রায়ের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলাম, হুমায়ূন আহমেদ স্যার নিজেই আমাকে দিয়ে তাঁর পরিচালনায় নির্মিত সর্বশেষ ছবি “ঘেঁটুপুত্র কমলা”র আবহসংগীতের কাজ করানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি জানার পর মনে হয়েছে, সংগীতপরিচালক হিসেবে আমি সার্থক।’
ইমন সাহা জানান, হুমায়ূন আহমেদের লেখা সর্বশেষ ‘ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে/নোটবুক নেই কাছে’ গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এই অনবদ্য গীতরচনার রীতি কেবল সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজের নাটক ও চলচ্চিত্রে; আর শেষের নয় বছর তা ছিল শুধু দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের জন্য। সে হিসাবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা গানের সংখ্যা তাঁর সাহিত্যকর্মের বিবেচনায় নগণ্য হলেও গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আকাশছোঁয়া। শাওনের একক ‘না মানুষী বনে’ এবং ‘যে আছে আঁখিপল্লবে’ অ্যালবাম দুটির বেশির ভাগ গান লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই অনিন্দ্য গীতিকবির লেখা (রেকর্ড হওয়া) শেষ গানটির কথা ছিল—‘ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে/নোটবুক নেই কাছে’।
গত বছর অসুস্থ হয়ে পড়ার কিছুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদ স্ত্রী শাওনকে নিয়ে দারুণ একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটি ছিল, শাওনের নতুন মৌলিক একক অ্যালবামের জন্য হুমায়ূন আহমেদ ও কবি নির্মলেন্দু গুণ ছাড়াও গান লিখবেন ওপার বাংলার শীর্ষ দুই সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সব গানের সুর করবেন এস আই টুটুল। এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ দুই বাংলার শীর্ষ তিন কবির সঙ্গে প্রাথমিক আলাপও করে রেখেছিলেন। এ অ্যালবামের জন্য তিনটি গানও লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় এই নন্দিত কথাশিল্পীর লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমীন, সুবীর নন্দী, অ্যান্ড্রু কিশোর, মমতাজ, কুমার বিশ্বজিত্, আগুন, সফি মণ্ডল, আঁখি আলমগীর, ফজলুর রহমান বাবু, হাবিব, কনা, কোনাল ও কিশোর। কেবল সাহিত্যেই নন, সংগীতেরও পরশপাথর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তা যেমন তাঁর লেখা গানের জনপ্রিয়তায় স্পষ্ট, তেমনি তাঁর গানের শিল্পীদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতেও।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা জনপ্রিয় কয়েকটি গান :
ও আমার উড়াল পঙ্খীরে
একটা ছিল সোনার কন্যা
বরষার প্রথম দিনে
আইজ আমরার কুসুম রানির বিবাহ হইবো
চাঁদনী পসর রাইতে কে আমারে স্মরণ করে
সোহাগপুর গ্রামে
চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়
আমার আছে জল
বাদল দিনে মনে পড়ে
যে থাকে আঁখি পল্লবে
যদি মন কাঁদে চলে এসো এক বরষায়
মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ
গরুর গাড়ির দুই চাকা
ঢোল বাজে দোতার বাজে
হাবলংগের বাজারে
0 comments:
Post a Comment