‘বাসা চিনতে কষ্ট হয়নি তো?’ শুরু করলেন তিনি। শাকিব খানের বিপরীতে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন জয়া—খবরটা এত দিনে জেনে গেছেন সবাই। খবরের সূত্র ধরে বললাম, ‘তাহলে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে আপনাকে দেখা যাবে এবার?’
এক মুহূর্ত ভাবলেন। এরপর ধীরে ধীরে জবাবের পালা, ‘বাণিজ্যিক ধারা, বিকল্পধারা—আমি এ রকম বিভাজনের পক্ষপাতী নই। আমার কাছে বিবেচ্য হলো, ভালো ছবি বা মন্দ ছবি। আর বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের কথা বললে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি প্রথম নয়, এরও আগে রেদোয়ান রনির চোরাবালিতে অভিনয় করেছি আমি। এটা কিন্তু পুরোদস্তুর অ্যাকশননির্ভর মূলধারার চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এবার নিজেকে অন্য একটা জায়গায় যাচাই করে নিতে চাই আমি।’
কথায় কথায় জম্পেশ হচ্ছে আড্ডা। সেই কথার ফোকর দিয়ে এই ঘরে এখন উঁকি মারছে গেরিলার বিলকিস। আর বিলকিস চরিত্রের প্রসঙ্গ তো আসতেই পারে এখানে। কেননা গেরিলা চলচ্চিত্রের এই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ২০১১-এর মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক শাখায় শ্রেষ্ঠ নারী অভিনয়শিল্পী হয়েছেন জয়া। সেই সঙ্গে টেলিভিশন নাটক চৈতা পাগল-এর জন্য দর্শকের মনোনয়নে পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা। একই বছরে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র উভয় মাধ্যমের শীর্ষ-মুকুট মাথায় নিয়ে ছক্কা-পাঞ্জার পুরোটাই যেন এখন তাঁর হাতে। তবে কি এসব অর্জন চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হতে উৎসাহ জোগাচ্ছে তাঁকে?
আমাদের অনুমানে যে কিছুটা গলদ আছে, জয়া আহসানের কথাতেই সেটি স্পষ্ট হলো আরও, ‘বিষয়টি এমন নয়। চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী শিল্প। অভিনয়, সংগীত, নৃত্যকলা, ভাস্কর্য, চিত্রকলা—অনেক কিছুর সমন্বয় থাকে এখানে। তাই এই মাধ্যমে কাজ করার মজাই আলাদা। তবে আমি কখনোই তথাকথিত উদ্ভট সিনেমার চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেব না। মাঝখানে টিভি নাটকের মান ভীষণ পড়ে গিয়েছিল। মূলত তখন থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি উৎসাহী হয়েছি। এ পর্যন্ত যতগুলো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, সেখানে আমার সবগুলো চরিত্রেই বৈচিত্র্য আছে। যেমন, চোরাবালিতে আমার চরিত্রটি একজন সাংবাদিকের। আবার কলকাতার ছবি আবর্ততে আমার ভূমিকা একজন অন্তর্মুখী গৃহবধূর।’
তাঁর কথা শেষ হয়নি। এর মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনির কাজ কবে শুরু হবে, টুকরো প্রশ্নে তাঁর আগের কথায় ছেদ পড়েছে খানিকটা। কিন্তু সেই ছেদ কাটিয়ে পরক্ষণেই জয়ার ত্বরিত উত্তর, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে এখন চিত্রনাট্যের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনের সেপ্টেম্বরে শুটিং শুরু হবে।’
বাইরে প্রবল বৃষ্টির তোড়। আর আমাদের মনের আয়নায় তখন ভাসছে শিউলি, তন্দ্রা, আঙুরলতা—জয়া অভিনীত অসংখ্য চরিত্রের মুখ। এবার সেই মুখগুলো মনে করতে করতেই তৈরি হলো প্রশ্ন, দিনে দিনে টেলিভিশন থেকে নিজেকে কি গুটিয়ে নিচ্ছেন? বাক্যের এটুকু শেষ হতে না হতেই না-বোধক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন জয়া। বললেন, ‘চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কিছু নাটকে কাজ করছি এখন। আসলে আমি সময় ও একাগ্রতা নিয়ে প্রতিটি কাজ করতে চাই। তাই একসঙ্গে খুব বেশি কাজ করতে পারি না। অনেক দিন থেকেই ভিন্নধর্মী এক্সপেরিমেন্টাল বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে আসছি। নাটকে অনেকবার নিজের গ্ল্যামার নিজেই ভেঙেছি আমি। সত্যি বলতে কি, ভিন্নধর্মী এসব চরিত্রে অভিনয় করতে করতে এখন মাঝেমধ্যে ক্লান্তি জাগে। প্রচলিত ধারার চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে চাই এখন। যে কারণে চৈতা পাগল নাটকে অভিনয় করেছি। আমাদের দেশে নির্মাতাদের অনেকেই শিল্পীদের নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রে বারবার অভিনয় করাতে চান। এভাবে একা আর যুদ্ধ করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে সহযোদ্ধা প্রয়োজন, প্রয়োজন বন্ধুসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বী। শিল্পী তো কাদামাটির মতো, নির্মাতা তাঁকে যেভাবে গড়বেন, সেভাবেই তিনি গড়ে উঠবেন।’
আমাদের সবার আড্ডায় এর মধ্যে গরম গরম চা এসে হাজির। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শোনা হচ্ছে অভিনেত্রী জয়ার বেড়ে ওঠার গল্প। একসময় হাসতে হাসতে জানালেন, ‘খুব ছোটবেলায় কাঠমিস্ত্রি হতে চেয়েছিলাম। ভালো ছবি আঁকতে পারতাম, চিত্রকলার ওপর ডিপ্লোমাও করেছি। কিন্তু অভিনয় যে করব, এমনটি কি ভেবেছিলাম কখনো?’ কথা বলতে বলতে এখন অন্যমনস্ক তিনি। হয়তো তাঁর এখন সদ্যপ্রয়াত বাবার কথা মনে পড়ছে। এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন জয়ার বাবা এ এস মাসউদ। বাবার কথা আসতেই আক্ষেপ ফুটে উঠল চোখে। বললেন, ‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমি কলকাতায় আবর্তর শেষ দৃশ্যের শুটিং করছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ, বাবার শেষ সময়ে তাঁর পাশে থাকতে পারিনি আমি।’
তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছে। ততক্ষণে ছোট্ট ঘরের চারদিকে ভর করেছে বিষণ্নতা। ওদিকে কথাও ফুরিয়েছে আমাদের, এবার পাততাড়ি গোটাতে হবে আড্ডার। ফলে আড্ডার শেষ পর্যায়ে জেঁকে বসা বিষণ্নতাকে কাটাতেই বললাম, আপনাদের ঘরটি অনেকটা জাদুঘরের মতো। সবখানে পুরোনো আবহ। এই কথায় সায় মেলালেন জয়াও। বললেন, ‘আমি পুরোনো জিনিস ভালোবাসি। পুরোনো সবকিছুর মধ্য দিয়ে ফিরে পেতে চাই স্মৃতিকে। তাই পুরোনো জিনিসগুলো সযত্নে তুলে রাখি স্মৃতিকে নতুন করে পাওয়ার জন্য।’
0 comments:
Post a Comment