প্রিয়তমা,
‘আমরা, অকৃতজ্ঞদের জন্য সানন্দে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছি। অনেক দিন ধরেই খুব সামান্য উপকরণ দিয়ে বিশাল কিছু করছি আমরা। এখন আমরা কিছু ছাড়াই অনেক কিছু করার যোগ্য।’
তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতায় আড়াআড়িভাবে এই কথাগুলো লেখা। সে আমাকে তাঁর কবিতাগুলো দেখাচ্ছিল। তখনই চোখে পড়ল এটা। আমি এখন এই যুবকের আতিথ্যে আছি। বিশ্বাস করো, তাপমাত্রা শূন্যের এত নিচে থাকা সত্ত্বেও মানুষটির প্রাণোচ্ছলতা এতটুকু ম্লান হয়নি। এটাই কিন্তু আমাদের প্রথম দেখা। সে জানে না, তাঁর ডায়েরির পাতায় যা লেখা আছে, সেটা মাদার তেরেসার কথা। আসলে মাদার তেরেসা কে—সেটাই তিনি জানেন না। এই কথাগুলো কোন পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছে, তা-ও কখনো জানতে চায়নি, তিনি ধরেই নিয়েছেন এগুলো তাঁর জন্যই বলা হয়েছে। কয়েক দিন আগে এই তরুণের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আসলেই কেমন জানি, তাঁর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। গতকালই আমি এখানে পৌঁছেছি। তার পরও কেমন করে জানি আমরা বন্ধু হয়ে গেছি। এখানে বাতাসে যেন কিছু একটা আছে, যা কিনা এখানকার বাসিন্দাদের বিরাট মঞ্চে একক অভিনেতা করে তোলে। এখানে আবেগ, গোপন বিষয়, নিজেদের মধ্যে আলাপের সময় ‘স্বাভাবিক’ভাবে কথা বলে না। অন্তত ‘সভ্য বিশ্বে’র ছকে বাধা কেজো কথার সময়ও না। আমি তাকে ওই উদ্ধৃতির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সহজেই বলল, আরেক দিন আলাপ করা যাবে।
আমার থাকার ঘরটা চিরাচরিত বাংকারের মতোই। তুমি এটাকে আমার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ বলতে পারো। বাংকার তৈরির সরঞ্জাম না থাকায় আমি কোনো রকমে নিজের হাতে ঘরটি বানিয়েছি। অনুচ্চ পাহাড়ের পাশে ১৪ বাই ১০ বাই ১০ ফুট মাপের এই কক্ষে একটি মাত্র জানালা। আর মাথার ওপরে ৭০টি কাঠ আড়াআড়ি দেওয়া। তুমি একে তুচ্ছ কথার ঝাঁপি বলতে পারো। কিন্তু প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমি তাদের একটা একটা করে গুনি। না না, ভেবো না আমার অনিদ্রা রোগ হয়েছে। আমি গুনি, কেননা, এই বিরূপ আবহাওয়ায় বাইরে আকাশে তারা গোনার সাহস পাই না।
একপাশে খালি কার্টনগুলো পাশাপাশি রেখে তার ওপর চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এর ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে এখানে নামাজ পড়ি। আমার হাতে এখন নামাজ পড়ার প্রচুর সময়। একসময় মনে হয়, সম্ভবত এখানে আমি আল্লাহকে খুব কাছ থেকে পাব। আরেক পাশেও খালি কার্টনের ওপর বিছানা তৈরি করেছি। কার্টনের ওপর বাতাস-ভর্তি তোশক এবং বালিশ দিয়ে সাজানো সেই বিছানা। তোমার দেওয়া সেই বড় বড় ফুলের আলপনা দেওয়া চাদর এই জীর্ণ ঘরে ঠিক মানায় না। ঘরের সঙ্গেই অন্ধকার এক শৌচাগার। কফ সিরাপের পুরোনো একটি শিশিকে কেরোসিনের বাতি বানিয়েছি। আলো হয় যত্সামান্যই। আর ঘিয়ের খালি টিনের পাত্রগুলোতে আমরা পানি গরম করি। এ ছাড়া খাবার ও জ্বালানির কিছু খালি পাত্র ঘরের ভেতরে শৈল্পিকভাবে রাখা হয়েছে। এসব খালি কার্টন দিয়ে খাবার টেবিল, জ্বালানির টিনকে চেয়ার বনিয়ে নিই।
খাবারের টেবিলটি মুরগির মাংস, নুডলস, বিস্কুট, ব্রিক গেমের বাক্স দিয়ে সুসজ্জিত। আর জনবিচ্ছিন্ন এই হিমবাহে আমাদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগের একমাত্র জানালা রেডিও। এখানকার আবহাওয়া, বাতাস, বিদ্যুত্ব্যবস্থা প্রতিনিয়তই আমাদের যোগাযোগের পথে শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি আছে ফুজিকা (কেরোসিনের হিটার), পেট্রোমেক্স ও তোমার পাঠানো বই। আর আছে মিলিটারি ফোন, যা কিনা তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সেটাও মৃতবত্।
দিনের সবচেয়ে ভালো সময় কাটে যখন আমরা রাতের খাবার খেতে বসি। ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে শাকসবজি এখানে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা বেঁচে আছি টিনভর্তি সামান্য ভাজা পেঁয়াজ ও টমেটোর ওপর। খাবার শেষে সবাই মিলে রেডিওর চারপাশ ঘিরে বসি। এক আঙুলের টিপে সারা পৃথিবী সামনে চলে আসে। তবে এখানে কোনো এফএম নেই। শুধু বিবিসি ও আঞ্চলিক কিছু চ্যানেল শুনতে পাওয়া যায়। আর বিবিসির পরিবর্তে রেডিও পাকিস্তানের রাতের সম্প্রচার শুনতে পাওয়া যায়। এভাবেই চলে যায় আরেকটি দিন।
দায়িত্ব বদল হয় অতন্দ্র সেনাদের। ঘরবাড়ি, বন্ধুবান্ধব, ফোন, এসএমএস থেকে বিচ্ছিন্ন এ সেনাসদস্যরা যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, যা কোনো টাকাকড়ি দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এখানকার সবচেয়ে বড় শক্র আবহাওয়া, বিশেষ করে আচমকা তুষারধস। তুমি কখনই এর গতিবিধি অনুমান করতে পারবে না। আর এই তুষারধসের মধ্যে পড়লে বুঝবে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ কী?
রেডিও খুলি আর নিচের সেনা কার্যালয় থেকে পাঠানো কাজের নির্দেশনা আমরা জানতে পারি। সবাই, বিশেষ করে জ্ঞানবান ব্যক্তিরা মনে করেন—কিছু না বুঝেই মনে করেন, আমরা এখানে উত্সব করছি। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০ হাজার ফুট উঁচুতে কীভাবে মজা করব। আমার মন বিদ্রোহী হয়। টমেটো, পুরি আর টিন-বন্দী সবজির জন্য কী বিপুল বাজেট? আমাদের ক্ষমতা-লোভীরা তো সবাইকে সমর্থন করেন। যেসব মানষ আমাদের ভালোবাসেন, তাঁদের কারণেই আসলে আমাদের এখানে থাকা। ১০ বাই ১৪-এর একটি ঘরে ফাঁকা কার্টনের ওপর আমাদের বিলাসী জীবন!! আমার মনে হয়, ডায়েরির পাতার ওই কথাগুলো একটুও বাড়িয়ে বলা হয়নি।
আশা করি শিগগির কথা হবে।
তোমার বিশ্বস্ত
এইচ
ভাষান্তর: লিপি রানী সাহা prothom-alo
0 comments:
Post a Comment