একসময় এই শোভাযাত্রা দেশের একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। উৎসাহিত হয়েছিলাম যশোরে এত বড় এবং সুন্দর একটা আয়োজন হচ্ছে বলে। ঢাকার মতো রাজধানী শহরেও এমন একটা আয়োজন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি আমরা। ১৯৮৯ সালে চারুশিল্পী সংসদে বসে ঢাকায় পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমি তখন চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি। চারুকলা থেকে পাস করা শিল্পীরা চারুশিল্পী সংসদের সদস্য ছিল। তাঁদের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্ররাও যুক্ত হয় এই আয়োজনে। আমাদের সঙ্গে যুক্ত করলাম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমদকে। তখন এত বড় একটি আয়োজন করার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না আমাদের হাতে। ফয়েজ আহমদের সঙ্গে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ছিল। তিনি ঢাকা শহরে খুব পরিচিত মানুষ। ফয়েজ আহমদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু অর্থ জোগাড় করে দিলেন। যত দূর মনে পড়ে, ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল আমাদের।
এই আয়োজনের পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। তিনি তখন ডিজাইন সেন্টারের চিফ ডিজাইনার ছিলেন। তাঁর ছেলে নিসার হোসেনও ছিল তখন চারুশিল্পী সংসদের একজন নিয়মিত সদস্য। প্রথমে কিন্তু এর নামকরণের কথা ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা। আলাপ-আলোচনার পর আমরা যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটাই ঠিক রাখলাম। শিল্পী রশীদ চীেধুরীর পরিকল্পনা ছিল ১০০ জন ঢুলি নিয়ে আসা হবে। এবং তাদের চারুকলার আশপাশের বিভিন্ন মোড়ে পাঁচ-সাতজন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। আর্থিক কারণে অবশ্য আমরা ১০ জন ঢুলি জোগাড় করতে পেরেছিলাম। সকাল থেকে ঢুলিরা চারুকলায় ঘুরে ঘুরে ঢোল বাজিয়েছে।
যত দূর মনে পড়ে, তখন চারুকলার অধ্যক্ষ ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সেই সময়টা তো খুব কার্যকরী দায়িত্ব পালন করেছিল, সাইদুল হক জুইস, তরুণ ঘোষ, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য। এদের নেতৃত্বে চারুকলার শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহে এই আয়োজন সম্পন্ন করেছে। সেই প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার করেছিল জুইস। লক্ষ্মীসরা ছিল সেই পোস্টারের বিষয়। আমরাও দেখিয়ে দিলাম কীভাবে কী করতে হবে। আর শিল্পী তরুণ ঘোষ তখন বিদেশ থেকে শিখে এসেছেন কীভাবে মুখোশ বানাতে হয়। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের প্রিয় ছাত্র জুইস। তিনি শিখিয়ে দিলেন কীভাবে মুখোশ তৈরি করতে হবে। মনে পড়ে, প্রথম প্রথম আমরা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে আসতাম। মনে আছে তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমি টোকাই করি। বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে এসেছিলাম। টাকা দিয়েছিলেন নিউ এজ সম্পাদক শহীদুল্লাহ খানও। ফতেহ আলী চৌধুরীও কিছু টাকার জোগান দেন। তখন আলাউদ্দিনের মিষ্টির কার্টুন করি আমি, গিয়ে ধরেছিলাম তাদেরও। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক) আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন আমাদের। শুরুতে না হলেও আমাদের এই মঙ্গলচেতনার সঙ্গে যুক্ত হন অনেকেই। সবাই সবার জায়গা থেকে বিপুল উদ্দীপনায় সাধ্যমতো কাজ করত। কাজটা করতে হবে, এটাই ছিল তখনকার মূল ব্যাপার।
প্রথম বছর শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা হয় ১০টি ছোট ঘোড়া আর বিশাল হাতি। ৫০টি মুখোশ তৈরি করা হয়েছিল। তখন দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চলছিল। আমরা চেয়েছিলাম, সেখানে একটা আঘাত করতে। আর তাই শোভাযাত্রায় রাক্ষসকে স্বৈরশাসকের প্রতিরূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার মাথায় রাখতে হয়েছে আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কি না, সেটাও। শোভাযাত্রার শুরুতে লোকসমাগম কম ছিল। কিন্তু অল্প পরেই সেটা একটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
আমাদের এই শোভাযাত্রা বিশ্বের বিস্ময়। এটা এই জন্য বলছি যে ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত নায়িকা অড্রে হেপবার্ন ঢাকায় আসেন। বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ঠিক কয়েক দিন পর। জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে তিনি এই সফর করেন। সেই সময় তিনি চারুকলায় আমার আঁকা টোকাইয়ের এক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। তখনো চারুকলার সর্বত্র শোভাযাত্রায় বহন করা জিনিসপত্র সাজানো ছিল। সেগুলো দেখে তিনি পাগল হয়ে যান। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন। ছুটোছুটি করতে থাকেন।
দু-এক বছর পরের কথা। শোভাযাত্রায় বিজ্ঞাপন হিসেবে কোম্পানির নাম লেখা বেলুন ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা খুব সমালোচিত হয়েছিল। পরে অনেক কোম্পানি টাকা দিতে চাইলেও আমরা আর সেই পথে যাইনি। আমরা কারও আর্থিক সহায়তা না নিয়ে নিজেরাই আয়োজন করার চিন্তা করি। আগের আয়োজন থেকে দেখেছি, শোভাযাত্রায় ব্যবহূত জিনিসগুলো মানুষ খুব পছন্দ করে নিয়ে যায়। তাই আমরা চিন্তা করলাম, শোভাযাত্রা শেষে এই জিনিসগুলো নিলামে বিক্রি করলে টাকার সংস্থান সম্ভব। আবার কারও কারও কাছ থেকে প্রস্তাব এল, আগে থেকে কিছু কিছু কাজ করেও টাকা জোগাড় করা যায়। সেই মতো এখনো ছাত্র-শিক্ষক ছবি এঁকে তা বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করেন।
তখন একটা বিষয়ে আমরা চিন্তা করেছিলাম। শিল্পী ও শিল্পানুরাগীরা হবে এই শোভাযাত্রার প্রাণ। এখন কিন্তু এটা একটা প্রতীকী অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ এই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছে। এখন দেখা যায়, সাধারণ মানুষ সারা বছর বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। তারপর থেকে প্রতিবছরই বৈশাখের প্রথম দিনে হয়ে আসছে প্রাণের উৎসব মঙ্গল শোভাযাত্রা। চৈত্রের প্রথম থেকেই শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। প্রতিবছর মাস্টার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা এই শোভাযাত্রার বড় কাজটা করে। তার সঙ্গে যোগ দেন পুরোনো অনেকেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। আমাদের যে বাঙালি সত্তা, তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। আর এটা কিন্তু একুশ থেকে দূরে নয়। একুশ আমাদের চেতনাকে বয়ে নিয়ে যায় বিজয়ের কাছে ২৬ মার্চে। আবার সেই বিজয় আমাদের দেয় স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ স্বাদ। পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ। আমরা আমাদের আনন্দকে সবখানে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমাদের সেই উদ্দেশ্য কিন্তু পুরোপুরিই সার্থক। প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment