আজ যখন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি, তখন প্রথম যে ভাবনাটি আমার মনে আসে সেটি হলো এই যে, সম্পর্কের উন্নয়নই শুধু নয়, সঠিক দৃষ্টিকোণও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিসাবি লোকেরা বলবেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিশাল বাজারটার সুযোগ নেওয়ার সময় এসেছে। আর যাঁরা আবেগপ্রবণ তাঁরা বলবেন, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অভিন্ন শিকড়ের মানুষদের মধ্যে একটা গভীরতর সম্পর্ক স্থাপন করা। বাস্তব বিষয়বুদ্ধির লোকেরা আলোচনা করবেন সব বাঙালি পণ্যের বাজারে ঢোকার বিষয়ে, যেন তা থেকে বই ও চলচ্চিত্রশিল্প উপকৃত হয়। সজল চোখে অন্যরা বলবেন, প্রতিবেশী এই দুটি দেশের মধ্যে যাওয়া-আসা যেন আরও সহজ করা হয়, সেটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কিছুটা দ্বিতীয় দলের মানুষ। আমি অস্বীকার করতে পারি না যে বাংলাদেশ নিয়ে যখন কথা বলি, তখন আমার মনে প্রবল আবেগ সঞ্চারিত হয়। কয়েক দশক আগে আমি যখন পূর্ব-পশ্চিম লিখি, তখন আমার মনের অবস্থা ছিল ওই রকম। একই অবস্থা হয়, যখন আমি লিখি দুই নারী, হাতে তরবারি। এ উপন্যাসে একটি বাংলাদেশি চরিত্র আছে। সম্প্রতি অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন অপরাজিতা তুমি নামে। আবারও আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি বসুধা ও তার মেয়ে লেখার সময়। আবেগ এমন একটি বিষয়, যা কেবল আমরা বাঙালিরাই ঠিকমতো বুঝতে পারি।
আমার জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়, ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। অনেকে মনে করেন, আমরা ভারতে এসেছি শরণার্থী হিসেবে; কিন্তু সত্যটা হলো, আমাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয় জন্মের এক বছর পরেই। আমার বাবা উত্তর কলকাতায় শিক্ষকতা করতেন, সেখানেই আমার শৈশব কাটে। তবু বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি এক অদ্ভুত ঘটনার কারণে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেললে আমাকে ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ফরিদপুরে জীবন ছিল খুবই অন্য রকম। কচি বয়স, সবকিছুর ছাপ পড়ে মনে। স্কুলে যাওয়া মানে ছিল গ্রামের পথে তিন মাইল হেঁটে যাওয়া। সাঁতারও শিখেছিলাম সেখানে, মা ও মাসিরা আমাকে পুকুরে ছুড়ে দিতেন, আমি দম নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতাম। কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া আমার শেখা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।
এখন কলকাতার বাসায় বসে ফরিদপুরের কথা ভাবি, সেই সব সুখস্মৃতি আমার সঙ্গী হয় আর আমার খুব মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতির অনেক অনেক কাজ করা প্রয়োজন। আইন ও অন্যান্য বাস্তবিক প্রক্রিয়াগত নিয়ম-কানুনের চেয়ে বাঙালিরা সীমান্তের ওপারের বিষয়গুলো আবেগ দিয়েই বেশি ভালো বুঝতে পারে। আমরাই বুঝতে পারি, দুই দেশের মধ্যে অবাধ আসা-যাওয়া, মেলামেশা, নেওয়া-দেওয়ার অনুকূল একটা ব্যবস্থা থাকা কত জরুরি। তাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ কেন্দ্রীয় সরকারের উপলব্ধিতে আনার দায়িত্ব আমাদেরই সবচেয়ে বেশি।
প্রথম পদক্ষেপটি হওয়া উচিত ভিসাব্যবস্থা আরও সহজ-সুলভ করা। আমি অনেক মানুষকে অভিযোগ করতে শুনেছি যে ভিসাব্যবস্থা ঝক্কি-ঝামেলাপূর্ণ, ভীষণ ক্লান্তিকর। হয়তো সার্ক দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াতের আরও সহজ পথ আমরা বের করতে পারি। আমি জানি, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি যখন আসবে তখন কাজটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার যোগাযোগের পথগুলো আরও উন্নত করা যায়।
শুধু ভৌত যোগাযোগই নয়, ভারতের জনগণের বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো দেখার সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশে আমার বন্ধুরা বলেন, তাঁরা আমাদের টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকগুলো নিয়মিত দেখেন। তাহলে আমরাও কেন তাঁদের ভালো অনুষ্ঠানগুলো দেখতে পাব না? দুই দেশের ভাষা তো একই। বইয়ের বিষয়েও একই কথা বলতে হয়। আমি যখন লিখছি, বাংলাদেশ আমার লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ছে একদমই অনায়াসে। বেশির ভাগই আমার সেখানে ফেলে আসা সময়ের স্মৃতি। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার লিখতে ইচ্ছা করে কি না, আমার উত্তর হবে নেতিবাচক। এটি খুবই স্পর্শকাতর, আমি বরং সেসব থেকে দূরেই থাকতে চাইব।
বাংলাদেশে অনেক লেখক আছেন, যাঁরা অত্যন্ত জনপ্রিয়। শামসুর রাহমানের কবিতা আমার ভালো লাগে। একটা ভালো খবর হচ্ছে, ভারতের কিছু প্রকাশক বাংলাদেশি লেখকদের বইয়ের ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বই পাইরেসি অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। লেখকদের সহযোগিতা করতে হবে, বইয়ের অবৈধ প্রকাশনা ও বিপণনের পথগুলো বন্ধ করতে হবে।
শেষে আমি বলব, বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন ঘটছে, সেটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার সময় এসেছে। বাংলাদেশে নারী সাক্ষরতার হার যে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, এটা কম মানুষই জানে। আমার মনে হয় এই সাক্ষরতা অভিযানটির ব্যাপক প্রচার হওয়া উচিত। আজ আমাদের চারপাশে যে ধরনের উন্নয়ন-অগ্রগতি ঘটছে, সেগুলোর প্রতি সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকানোর পাশাপাশি আমাদের উচিত শ্বাসরুদ্ধকর সীমান্ত পেরিয়ে যা-কিছু ভালো ও কল্যাণকর তার সবকিছুই যৌথভাবে হূদয়ঙ্গম ও আত্মস্থ করা। আমার মনে হয়, এটাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের কবি ও কথাসাহিত্যিক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
১৭ ফেব্রুয়ারি, টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত
0 comments:
Post a Comment