সব হয়েছে। শুধু স্বপ্নের চাকরির সুযোগটা মিলল না। উল্টো গ্রেপ্তার হয়ে নিরাপত্তা ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন। মরুর দেশ শুধু তাঁদের নয়, যেন তাঁদের স্বপ্নের পায়েও বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে।
লিবিয়ার আল-কুফরা শহরের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে আটক ৩০৬ বাংলাদেশির জীবনের গল্প এটি। গত দুই দিনে লিবিয়ার এক সেনা কর্মকর্তার মুঠোফোনের মাধ্যমে কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে ঘণ্টা খানেক কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
আটক বাংলাদেশি ও দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, দালাল চক্র একইভাবে মিসর, সুদান, নাইজার, শাদ হয়েও অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের পাঠাচ্ছে লিবিয়ায়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে প্রায়ই গ্রেপ্তার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী জানান, ‘আল কুফরার একটি ক্যাম্পে ৩০৬ জন এবং আরেকটি ক্যাম্পে ১৬ জন বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার আছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
লিবিয়ার যে অস্থায়ী ক্যাম্পে ওই বাংলাদেশিদের রাখা হয়েছে, সেটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভবন। তাঁরা সেখানে খাবার ও পানির পাশাপাশি শীতে কষ্টে আছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আল কুফরার সেন্ট্রাল হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে কাজ করেন একমাত্র বাংলাদেশি চিকিৎসক আবদুল হালিম। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘কুফরার ওই ক্যাম্পে ৩০৬ জন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার প্রতিদিনই কথা হচ্ছে। তাঁরা সবাই অবৈধভাবে সুদান হয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তাঁদের কারও কাছেই পাসপোর্ট নেই।’
বাংলাদেশি এই চিকিৎসকের সহায়তায় কুফরার ওই ক্যাম্পের লিবীয় এক সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমেই কথা হয় নওগাঁর হারুন, আকতার ও দেলোয়ার হোসেন; গাজীপুরের হোসেন খান, বগুড়ার গফুর, ফরিদপুরের হানিফ ও যাত্রাবাড়ীর মুস্তাফিজের সঙ্গে। তাঁরা জানান, দালালরা তাঁদের ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে এখন অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঢেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশি চিকিৎসক আবদুল হালিম বলেন, ‘এই শহরে গত কয়েক দিনে ২৫ থেকে ৩০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। লিবিয়ার পুলিশ তাঁদের ভাষা বুঝতে না পারায় আমার শরণাপন্ন হয়। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “এরা তোমার দেশের লোক, নাকি গুপ্তচর।” আমি পুলিশকে বোঝাই, এদের কাজ দেওয়ার নামে প্রতারণা করে আনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, এই বাংলাদেশিরা জানেন না, পাসপোর্ট ছাড়া তাঁরা কখনো রাজধানী ত্রিপোলি বা অন্য কোনো শহরে যেতে পারবেন না।
বাংলাদেশিরা যা বলছেন: আটক হারুন মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ঢাকায় কাজ করতাম। সোলেমান নামের এক দালালকে দেড় লাখ টাকা দিই। আমাকে ঢাকা থেকে ইয়েমেন নেওয়া হয়। ইয়েমেন থেকে সুদান। সুদানে ২৮ দিন ছিলাম। সেখানে রাশেদ নামের আরেক দালাল পাসপোর্ট রেখে আমাকে লিবিয়ায় ঢুকিয়ে দেয়। মরুভূমি পেরিয়ে কুফরায় আসার পরই পুলিশ গ্রেপ্তার করে।’
ফরিদপুরের হানিফ জানান, বকর নামের এক দালাল টাকা নিয়ে তাঁকে ফকিরাপুলের একটি অফিসে নিয়ে যায়। এরপর দালালরা তাঁকে সুদানে নিয়ে যায়। সেখান থেকে লিবিয়া।
নওগাঁর দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুই লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে মঈন নামের এক দালাল আমাকে সুদান হয়ে লিবিয়া পাঠানোর কথা বলে। নওগাঁয় মঈনের স্ত্রীর কাছে আমি টাকা দিছি। মঈন সুদানে থাকে। মঈনই আমাকে লিবিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
টাঙ্গাইলের মধুপুরের আবদুল কাদের বলেন, ‘আমার কাছ থেকে মোট নেওয়া হয়েছে পাঁঁচ লাখ টাকা। কথা ছিল সিঙ্গাপুরে পাঠাবে। টাকা নিছে রুহুল আমিন। একদিন রুহুল আমিন আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে ১৭ দিন রাখে। তারপর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একজন আমার হাতে পাসপোর্ট তুলে দেয়। যাই দুবাই। সেখান থেকে সুদান যাওয়ার পর শামীম নামের এক দালাল আমাকে গ্রহণ করে। এর মধ্যে শামীম আরও লোকজনের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা মেরে চলে যায়। ওই বাংলাদেশিরা আমাকে শামীমের লোক মনে করে ৪১ দিন আটকে রাখে। সেখান থেকে পালালে রাস্তায় আমার সঙ্গে টাঙ্গাইলের আরেক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে লিবিয়া নিয়ে আসেন।’
বেসিস ওভারসিজ: রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লিবিয়া যাওয়ার কথা জানান গোপালগঞ্জের ইব্রাহিম শেখ। তিনি বলেন, তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক মজিবুর। অফিস কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, জোনাকি সিনেমা হলের সামনের বেসিস ওভারসিজ।
মজিবুরের মাধ্যমে আর কোনো বাংলাদেশি এসেছেন কি না জানতে চাইলে মুঠোফোনে ওই ক্যাম্প থেকে উত্তর দেন কুষ্টিয়ার আজগর আলী। তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিছে মজিবুর। এরপর আমাকে দুবাই নেওয়া হয়। দুবাই থেকে নেওয়া হয় ইথিওপিয়া। ইথিওফিয়া থেকে উগান্ডা। সেখানে এনামুল নামের এক দালাল আমাকে গ্রহণ করে। উগান্ডা থেকে আরেকটি জায়গায় নেওয়া হয়, নাম মনে নেই। সেখানে আড়াই মাস রাখার পর নেওয়া হয় সুদান। এরপর লিবিয়া।’
লিবিয়ার ওই ক্যাম্পে আটক বেশ কজন বাংলাদেশিই এই মজিবুর রহমানের নাম বলেছেন। তাঁর এজেন্সিটির নাম বেসিস ওভারসিজ। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে ২৭ নয়াপল্টনের ডিআইটি রোডে।
মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। অফিসের টেলিফোনে ফোন করলে কেউ ধরেননি। বেসিস ওভারসিজ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রিক্রুটিং এজেন্সিটির লাইসেন্স নম্বর ৯৭২। নতুন লাইসেন্স পেয়েছে। আগে কখনো এই ব্যবসা করেনি।’
জানা গেছে, অধিকাংশ বাংলাদেশিকেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী বলেন, ‘সবার কাছে অনুরোধ, অবৈধ উপায়ে লিবিয়া এসে জীবনটা কারাগারে কাটাবেন না।’
দূতাবাসের উদ্বেগ: সম্প্রতি লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জরুরি প্রতিবেদন পাঠিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের সে দেশে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে দালাল চক্র প্রথমে পর্যটক ভিসায় কর্মীদের মিসর, সুদান, নাইজার, শাদ ও আলজেরিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে মরুপথে অবৈধভাবে লিবিয়ায় অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। লিবিয়ার পুলিশ গত ১২ অক্টোবর কুফরা থেকে এমন ১৩ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, এর পর থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ জন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। কোনোভাবেই লিবিয়ার সম্ভাবনাময় বাজার ধ্বংস হতে দেওয়া হবে না। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া পুনর্গঠনে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতে পারে। কিন্তু অবৈধভাবে বাংলাদেশিরা যাওয়ার কারণে সব সম্ভাবনা ভেস্তে যেতে বসেছে। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment