আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামের নির্বাচনী এলাকার ছয়টি স্কুল-কলেজ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একই ভাষায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও বাধ্য হয়ে একই বিজ্ঞাপন প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিল পাস হয়। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি বিলে সই করেন। বিল পাসের দিনই সাংসদ আসলামুল হকের দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ঢাকা-১৪ সংসদীয় এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দেন। বিজ্ঞাপনের ভাষা পরিবর্তন না করে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের নামে জরুরি ভিত্তিতে ছাপতে বলা হয়। আসলামুল হক ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা সভাপতি।
একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সাংসদের এই ইচ্ছার কথা এবং অভিনন্দনবার্তার অনুলিপি তাঁদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নিজস্ব তহবিল থেকে এই বিজ্ঞাপন দিতে বলা হয়েছে। তা ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য দুটি পত্রিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাংসদ আসলামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কাউকে কিছু বলিনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-উদ্যোগে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এই বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।’ সব বিজ্ঞাপনের ভাষা একই রকম হওয়া প্রসঙ্গে ওই সাংসদ বলেন, অভিনন্দনের ভাষা তো একই রকম হতেই পারে। এটি অপচয় বা চাপিয়ে দেওয়া কি না, জানতে চাইলে আসলামুল হক বলেন, সব উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত নয়।
সাংসদের এ বক্তব্য নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মিরপুর এলাকার কয়েকজন প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষকে সাংসদের ব্যক্তিগত দুই কর্মকর্তা ফোন করেন। তাঁরা ওই শিক্ষকদের বলেন, সাংসদের নির্দেশে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা যেন সাংবাদিকদের বলা না হয়। স্কুল-কলেজগুলো নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, এ কথা সাংবাদিকদের জানাতে অনুরোধ করেন ওই দুই কর্মকর্তা।
অভিনন্দনবার্তায় ভাষার হেরফের নেই: পত্রিকায় প্রকাশিত ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে ভাষার কোনো হেরফের পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞাপনের ভাষা এ রকম, ‘নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করায় সংসদীয় আসন ঢাকা-১৪, ... স্কুল/কলেজের সকল সম্মানিত শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও সম্মানিত অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন।’
চারটি কলেজের হুবহু অভিনন্দন একটি পত্রিকায়: গত বৃহস্পতিবার একই ভাষায় একটি জাতীয় দৈনিকে চারটি কলেজের অভিনন্দনবার্তা ছাপা হয়। সব বিজ্ঞাপনের দুই পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মিরপুর বাঙলা কলেজ, হজরত শাহ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং হজরত শাহ আলী মডেল হাইস্কুল। বৃহস্পতিবার আরেকটি দৈনিকে একই ভাষায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে হজরত শাহ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
গতকালও একটি দৈনিকের সপ্তম পৃষ্ঠায় এ বিজ্ঞাপন পাশাপাশি দুটি কলেজের নামে ছাপা হয়। এর একটি বশির উদ্দিন আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নামে, অপরটি মিরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের নামে। সিদ্ধান্ত হাইস্কুল গতকাল আরেকটি জাতীয় দৈনিকে একই ভাষায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে।
শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ, মেনে নিতে বাধ্য: অভিনন্দনবার্তা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সিটি করপোরেশনের বিভক্তি চান না। কিন্তু বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই বিভক্তির সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাতে তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে। আর্থিক অপচয় ছাড়াও এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্তরায় বলে একজন প্রধান শিক্ষক ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া স্কুল-কলেজের এই টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন-ফি বাবদ নেওয়া হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত যদি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করা যেত, তাহলে করপোরেট হাউসগুলো টাকা ঢেলে সব সিদ্ধান্ত বৈধ, গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে ফেলতে পারত। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকায় এ ধরনের বিতর্কিত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর করতে না হয়, সে জন্য মন্ত্রণালয়ের উচিত জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকার অভাব রয়েছে, গ্রন্থাগারে বই, গবেষণাগারে যন্ত্রপাতির ঘাটতি আছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের পেছনে লাখ টাকা খরচ না করে শিক্ষার্থীদের ওই সব চাহিদা পূরণ করা উচিত। ডিসিসি ভাগের সিদ্ধান্ত কতটা জনপ্রিয়, তা যাচাই করতে গোপনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে জরিপ করে ধারণা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment