কিন্তু বললেই তো হলো না। এখন ইরাকের রাজধানী বাগদাদে উপযুক্ত পুরুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। বাগদাদের উপকণ্ঠে তৈরি শিবিরগুলোতে এখন হাজার বিধবা নারীর ভিড়। সরকারের সামান্য অর্থ সাহায্যে কোনোমতে দিন গুজরান হয় তাঁদের। সেখানে কোনো পুরুষের দেখা মেলে কালেভদ্রে। আর মিলবেই বা কীভাবে, ইরাকজুড়ে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষেরাও ওই সব শিবিরের পথ মাড়ান না। কারণ, বিয়ের পাত্রী হিসেবে বিধবারা খুব একটা আকর্ষণীয় নন তাদের কাছে। ফলে তাদের জন্য সরকার আর এনজিওগুলোই ভরসা। নরিয়াই বললেন এ সম্পর্কে। তাঁর মতে, শুধু এক বা দুই সন্তানের জননী কোনো তরুণী বিধবার ক্ষেত্রেই আবার বিয়ের সম্ভাবনা আছে। সঙ্গে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। তিনি ছয় সন্তানের জননী।
বিধবা রাজা হাশমির (৩২) এর মধ্যে একটু ব্যতিক্রম। তাঁর তিনটি ছোট ছোট ছেলে। তাঁর বক্তব্য, ‘আমার আর কোনো পুরুষের দরকার নেই। কারণ, আমার সঙ্গে তিনটি পুরুষ আছে।’
তবে বিধবারা ইরাকের কোনো নতুন সমস্যা নন। এ সমস্যার শুরু ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে, যখন ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইরানের সঙ্গে। প্রায় দশক জুড়ে চলা এই যুদ্ধে ১০ হাজার ইরাকি নারী বিধবা হন। এরপর কুয়েত দখল ও যুদ্ধ। দেশের ভেতরে কুর্দিদের সঙ্গে সংঘাত। সর্বোপরি ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনী ও তার মিত্রদের অভিযানে স্বামীহারা নারীর সংখ্যা আকাশ ছোঁয়া পর্যায়ে চলে যায়।
ইরাকের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী সে দেশে বিধবা নারী সংখ্যা প্রায় নয় লাখ। কিন্তু মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত জুন মাসে এক বিবৃতিতে এ সংখ্যা ১০ লাখ বলে জানিয়েছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সালে ইরাকে জাতিগত সহিংসতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময় প্রতিদিন প্রায় ১০০ নারী স্বামী হারিয়েছেন। ইরাকের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যুদ্ধে স্বামীহারা ৮৬ হাজার নারীকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা কোনোভাবেই এক লাখ ১৩ হাজারের কম হওয়া উচিত নয়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ সালে মার্কিন অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই ১০ হাজার ইরাকি সেনা প্রাণ হারায়। পরবর্তীকালে সন্ত্রাসী হামলা ও জাতিগত সংঘর্ষে ১০ হাজারের বেশি পুলিশ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য নিহত হন।
ইরাকজুড়ে এখন বিধবাদের হাহাকার। তাঁদের জন্য সরকারি সাহায্য সামান্যই। মাসে ৮০ মার্কিন ডলার। এ অর্থে সন্তান নিয়ে দিনাতিপাত করা তাঁদের জন্য প্রায় অসম্ভব। নরিয়া খালাপে বলছেন, ‘আমেরিকা, ইরাক—সব পক্ষের কাছ থেকে সাহায্য পাব এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে কেউই আমাদের গোনার মধ্যে ধরে না।’
ইরাকের বিধবাদের শিবিরগুলোতে যে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিধবাদের পুনর্বিবাহের কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিধবাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে মার্কিন অর্থায়নে কিছু প্রকল্প চলছে ইরাকে। ওই নারীদের বিউটি পার্লার ও ক্যাটারিংয়ের মতো ব্যবসায় স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে সাফল্যও কিছু আছে। প্রকল্পের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের দাবি, এতে বিপদগ্রস্ত ওই নারীদের দৈনন্দিন জীবনধারণে শুধু পরিবর্তন আসছে না, তাঁরা গভীর বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারছেন।
এ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন এমন অনেক নারী যাঁরা চোখের সামনে তাঁদের স্বামীকে খুন হতে দেখেছেন। ফলে কোনো কাজে মনোযোগী হতে পারছেন না অনেকেই। কেউ কেউ আবার অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছেন। হূদরোগের সমস্যায় আক্রান্ত অনেকে। ছোটখাটো এই ব্যবসা তাঁদের এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে। তাঁদের মুখে হাসি ফিরে এসেছে। তাঁরা জোরে কথা বলতে পারছেন।
ইরাকে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে জীবন্ত প্রতিবাদ হয়ে উঠেছেন এই স্বামীহারা নারীরা। যদিও ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনাসদস্যরা বিধবা শিবিরগুলোতে বাচ্চাদের জন্য কখনো কখনো চকলেট ও ফুটবল বিলিয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষোভের মাত্রা কখনো কমেনি। ২০০৮ সালে এক ইরাকি সাংবাদিক তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের দিকে জুতো ছুড়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন তিনি চিত্কার করে বলেছিলেন, ইরাক যুদ্ধের কারণে যে নারীরা স্বামী, যে শিশুরা বাবা হারিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে তিনি এভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্রদের কারণে ইরাকের নারীরা যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন তা থেকে সহজে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই। তাই ওই নারীদের আপাতত কান্নাই একমাত্র ভরসা। যদিও তা ইরাকি শাসক বা তাদের মিত্রদের কানে পৌঁছায় কি না তা কেউ জানে না। নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে।
0 comments:
Post a Comment