আবার গ্রাহক সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসালে সরকারও যে খুব একটা লাভবান হচ্ছে, তা-ও নয়। কারণ, যত সংখ্যক প্যানেল এখন পর্যন্ত বসেছে, তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক মেগাওয়াটও বাড়েনি।
বরং সরকারি এই শর্তের সুযোগে অনেক নতুন ব্যবসায়ী প্যানেলের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁরা নিম্নমানের প্যানেল বেশি দামে বিক্রি করছেন। কেউ আবার আগ্রহী গ্রাহকের কাছে মাসিক ভিত্তিতে প্যানেল ভাড়াও দিচ্ছেন।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন কয়েকটি এলাকায় গ্রাহক, প্যানেল ব্যবসায়ী ও বিদ্যুৎকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) সূত্রগুলো থেকেও একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগের জন্য সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানোর শর্ত তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালকের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় তাঁরা এই দাবি জানান। অনেক গ্রাহক প্রথম আলোর কাছেও একই দাবির কথা বলেছেন।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের শর্ত বাতিল কিংবা শিথিল করা হবে না। বরং নতুন করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে গ্রাহকদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্যানেলের দাম অনেক কমেছে। কীভাবে সহজে তা পাওয়া যাবে, তা-ও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে।
বিদ্যুৎসচিব যুক্তি দেন, ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই এই শর্ত বহাল রাখা দরকার।
সরকার জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এবং নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার বাড়াতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানোর শর্ত আরোপ করেছে। এই শর্তের কারণে নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কিছু বাড়তি সময় পাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। শীতকালও চলে এসেছে। এ সময় ওই শর্তের বেড়াজালে বিদ্যুতের সংকট কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে। প্যানেল বসানো গ্রাহকেরা লোডশেডিংয়ের সময় কিছু আলো এবং কেউ কেউ ফ্যান ব্যবহার করতে পারছেন।
গ্রাহকের কথা: ধনী, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ—এই তিন স্তরের গ্রাহকই প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সরকারি শর্তের কারণে বাধ্য হয়ে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়েছেন। এতে অর্থ ব্যয় ছাড়াও অনেক ঝক্কি-ঝামেলা গেছে। কিন্তু লাভ তেমন কিছু হচ্ছে না।
রাজধানীর বাড্ডা থানার সাঁতারকুল ইউনিয়নের পূর্ব পদরদিয়া এলাকার সাজ্জাদ আলী একটি কাঠ চেরাই কারখানার মালিক। নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ পাওয়ার আগে তাঁকে প্রায় আট মাস কারখানাটি ডিজেলে চালাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৭ ওয়াট পিক ক্ষমতার (প্যানেলটি প্রতিদিন একটি সময়ে সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ দেবে) একটি প্যানেল তাঁকে বসাতে হয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এতে কার কী লাভ হইছে, জানি না। কিন্তু আমি বহুত কষ্ট পাইছি। কয়েক মাস রইছি শুধু দৌড়ের ওপর। এখন বিদ্যুৎ না থাকলে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে একটি লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকি। আর কোনো কাজ এতে হয় না।’
ওখানকার ৭ নম্বর বাড়ির মালিক, অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক এফ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারি শর্তের কারণে সাত লাখ ২০ হাজার টাকায় ১ দশমিক ৮৯ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতার প্যানেল বসিয়েছেন। একটি ইনভার্টার (সৌর প্যানেল থেকে পাওয়া ডিসি বিদ্যুৎকে এসি বিদ্যুতে রূপান্তর করার যন্ত্র) বসিয়ে কিছু লাইট ও ফ্যান চালাচ্ছেন। এক কিলোওয়াট পিকের মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। যখন লোডশেডিং হয় তখন কাজে লাগে। সে জন্য এত টাকা ব্যয়ে এই ব্যবস্থার কোনো দরকার ছিল না তাঁর।
কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার কয়েকজন বাড়িমালিকও একই কথা বলেন। তাঁরা আট থেকে ১৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে প্যানেল বসিয়েছেন। তা থেকে পাওয়া বিদ্যুতে কেউ শুধুই কিছু লাইট জ্বালাচ্ছেন। কেউ কেউ ইনভার্টার স্থাপন করে কিছু ফ্যান চালাচ্ছেন। লোডশেডিং ছাড়া তাঁদের সৌরবিদ্যুতের কোনো ব্যবহার নেই।
সংযোগের সংখ্যা কত: এখন পর্যন্ত ডিপিডিসি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় ১৭ হাজার গ্রাহককে নতুন সংযোগ দিয়েছে। এদের মোট বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় আট মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসাতে হয়েছে প্রায় ৩৫০ জন গ্রাহককে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৭৫ কিলোওয়াট পিক বা এক মেগাওয়াটের ছয় ভাগের এক ভাগের মতো।
ডেসকো এখন পর্যন্ত নতুন সংযোগ দিয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার গ্রাহককে। এর মধ্যে প্যানেল বসিয়েছেন প্রায় ৪০০ জন, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ কিলোওয়াট পিকের মতো।
এ ছাড়া পিডিবি, আরইবি ও ওজোপাডিকোর গ্রাহকেরা এখন পর্যন্ত যতগুলো প্যানেল বসিয়েছেন, তার সর্বমোট ক্ষমতা এক মেগাওয়াটের বেশি হবে না।
প্যানেল বসানোর পরও সংযোগ পেতে বিলম্ব প্রসঙ্গে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রচুর আবেদনপত্র আগেরই জমা আছে। আরও নতুন আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে কত ক্ষমতার প্যানেল বসাতে হবে, তা একবারে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। সর্বোপরি জনবল সীমিত।
সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানোর ফলে গ্রিডের বিদ্যুতের চাহিদা কিছু কমেছে কি না, এ সম্পর্কে মনজুর রহমান বলেন, গ্রিডের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। যেখানে হাজার হাজার মেগাওয়াট চাহিদা ও সরবরাহের ব্যাপার, সেখানে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে পাওয়া সামান্য বিদ্যুৎ কোনো হিসাবের মধ্যে আসার কথা নয়।
নিম্নমানের প্যানেল: পশ্চিম আগারগাঁওয়ে একটি বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে। ক্ষমতা ৪৮ কিলোওয়াট পিক। ৩৫টি লাইট ও ৩৫টি ফ্যান চার ঘণ্টা চলার মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা। এক দিনই তা হয়েছিল। এখন আর হচ্ছে না। ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়ক ও সেন্ট্রাল রোডের কয়েকজন গ্রাহকও বলেছেন, তাঁরা যে ক্ষমতার প্যানেল বসিয়েছেন সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ তাঁদের নিম্নমানের প্যানেল দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) এবং বাংলাদেশ সোলার এনার্জি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী-প্রকৌশলীরা কিছুটা কারসাজি করতে পারেন। তিনি অনেকগুলো বাড়ির প্যানেল পরীক্ষা করে দেখেছেন, দরকার ৫০০ ওয়াট পিক প্যানেল। সেখানে ৩০০ ওয়াট পিক লাগিয়ে সরকারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে ৫০০ ওয়াট পিক। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের এমনকি পুরোনো প্যানেল লাগানোর ঘটনাও ঘটেছে। তিনি ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এমন অনেকগুলো প্যানেল দেখেছেন বলে জানান।
সৌরবিদ্যুতের প্যানেল আমদানিকারক ও স্থাপনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সোলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিম্নমানের প্যানেল সরবরাহের কথা আমরাও শুনি। তবে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা খুব কম বলে মনে হয়।’ প্যানেলের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁরা ল্যাবরেটরি স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানান।
গ্রামীণ শক্তির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. ফজলে রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নতুন নতুন কিছু কোম্পানি বাজারে এসেছে। তারা যেসব প্যানেল সরবরাহ করছে, তার মান যাচাই করার কেউ নেই। প্যানেলের মান নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাচ্ছে না। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে প্যানেল বসাতে হয়, তাই বসাচ্ছে।’
0 comments:
Post a Comment