খানিক পর উন্মোচিত হলো রহস্য। বন্দরকর্মীরা খালি কনটেইনারের দরজা খুলতেই নাকে এসে ঝাপটা দিল উৎকট গন্ধ। গন্ধে পিছু হটলেন কেউ কেউ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কনটেইনারের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকেন হাড্ডিসার একজন মানুষ! শরীরে কোনো পোশাক নেই। গাল ভেতরে ঢুকে গেছে। এ কি দেখছেন তাঁরা! টং গো ইয়ান তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন ঘটনার মুখোমুখি হননি।
কঙ্কালসার লোকটি কনটেইনারের দরজায় এসে হাতের ইশারায় পানি খোঁজেন। তাৎক্ষণিকভাবে এক বোতল পানি পেয়ে মুখে তুলে নেন লোকটি। পুলিশ ও বন্দরকর্মীরা এবার কনটেইনারের কাছে গিয়ে দেখেন, ভেতরে পড়ে আছে নিথর একটি দেহ। উৎকট গন্ধে নাক বন্ধ করেন সবাই। হঠাৎ ব্যস্ততা বাড়ে টার্মিনালের এই অংশে। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের ভোঁ ভোঁ শব্দ। একটিতে তোলা হয় পচে যাওয়া লাশ। আরেকটিতে মৃতপ্রায় লোকটিকে। তবে তাঁর হাতে হাতকড়া পরাতে ভোলেনি সিঙ্গাপুরের পুলিশ।
তখনো কারও জানা ছিল না কীভাবে ঘটল এ ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে কনটেইনারটি আসার খবর জেনে হাসপাতালে কলকাতার এক নারী কর্মীকে ডেকে আনা হয়। শুরু হয় কথোপকথন।
নাম কী? দীন ইসলাম। আস্তে-ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে দীন ইসলামের মৃত্যুকে ছুঁয়ে আসার ভয়ংকর গল্প...।
ঘটনার শুরু
দীন ইসলামের বাবার সবজির দোকান ছিল চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুরে। সেই দোকানে সবজি বিক্রি করে দিন কাটত তাঁর। ভবঘুরে দীন ইসলামের সারা দিন দোকানে বসে থাকতে ভালো লাগত না। অভাবী পরিবারে পড়াশোনাও করা হয়নি। জীবনের গন্তব্যও যেন অর্থহীন। একসময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই টান ভবঘুরে জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ায়। বাড়ি থেকে বের হলে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন চার-পাঁচ দিন। এমন ভবঘুরের সঙ্গী হয়ে থাকতে চাননি তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। কোলের সন্তানকে নিয়ে দেড় বছর আগে কুমিল্লার লাকসামে বাবার বাড়িতে চলে যান তিনি। আরও বেশি ওলট-পালট হয়ে যায় দীন ইসলামের সবকিছু। বাসায় বকাঝকা খেয়ে কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন এদিক-সেদিক। কাজ জুটলে খাবার, না জুটলে উপোস। কাজের খোঁজে একদিন চলে যান বন্দরের ৩ নম্বর গেটের সামনে। কোনো কোনো দিন ডাক পড়ে মাঝিদের (শ্রমিক সরবরাহকারী)। দিনে ২৫০ টাকা। গত ১ এপ্রিলও দীন ইসলামের ডাক পড়ে। অজ্ঞাতনামা সেই মাঝি বন্দরের ৪ নম্বর গেট দিয়ে দীনসহ আরও কয়েকজন নিয়ে ছুটে যান জেটিতে।
২ নম্বর জেটির এমভি কুইন জাহাজে চাল খালাসের কাজ চলছিল। দীনের কাজ ছিল জাহাজের খোলের মধ্যে বস্তা ছিঁড়ে পড়ে যাওয়া চাল এক জায়গায় জড়ো করা। সন্ধ্যা ছয়টায় কাজ শেষে ২৫০ টাকা মজুরি পান দীন। এরপর সহকর্মী আল-আমিনকে নিয়ে জেটির পাশের এক ক্যানটিনে খাবার খেয়ে নেন। খাওয়া শেষে দুই বন্ধু ঢুকে পড়েন একটি খালি কনটেইনারে। এর পরের অংশ ঠিক পুরোপুরি মনে নেই তাঁদের। হতে পারে নেশার প্রভাবে বা ঘুমের ঘোরে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।
নয় দিনের মুত্যুযন্ত্রণা
দুজনের ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। কনটেইনারের ভেতরে তখন অন্ধকার। চোখ মুছে দরজার কাছে গিয়ে দেখেন, কনটেইনার বাইরে থেকে বন্ধ। হাত দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন তাঁরা। খুলছে না দরজা। চিৎকার করেন গলা ছেড়ে। কেউ শুনছে না। কনটেইনার থেকে বের হওয়ার উপায় খোঁজেন, কিন্তু বাইরে শব্দ যাওয়ার মতো কোনো ফুটো নেই। তবু একটু পরপর লোহার দরজায় আঘাত করতে থাকেন দুজনে। এভাবে মিনিট, ঘণ্টা পার হয়। একসময় বুঝতে পারেন, কী সর্বনাশ ঘটে গেছে তাঁদের জীবনে!
অল্প অল্প করে সংবিৎ ফিরে আসতে থাকে দীন ও আমিনের। তাঁরা তখনো জানেন না, কনটেইনারটি তখন এমভি হ্যানসা কালিডোনিয়া জাহাজে চড়ে রওনা হয়ে গেছে সিঙ্গাপুরের পথে।
অন্ধকারে কেউ কাউকে পরিষ্কার দেখতে পান না। দুজন দুজনকে অন্ধকারে হাতড়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কথা বলেন। চিৎকার-চেঁচামেচি কোনো কিছুরই ফল হয় না। সময় পেরিয়ে যায়। কনটেইনারের ভেতরে হঠাৎ তীব্র গরম অনুভব হয়। আবার শীত। দীন আমিনকে অনুমানে বুঝতে হয়, গরম-শীতের পার্থক্য মনে হয় দিন-রাতের কারণে। কিন্তু পানি নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই। এভাবে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়? দীন দিন গোনেন। গরম-শীতের পার্থক্য করে দুই বন্ধু দিনের হিসাব কষেন। এদিকে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় নিজের প্রস্রাব মুখে তুলে নেন দীন। দুজনের কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে।
তিন দিনের মাথায় আল-আমিনের কথা আর শোনা যায় না। দুর্বল শরীর তাঁর। টানা কথা বলারও শক্তি নেই। অস্পষ্ট স্বরে মা-বাবার নাম ধরে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকেন। দীনের কানে সেই শব্দ ভেঙে ভেঙে আসে। সময় পার হয়। ‘পানি দে, ওমা আমারে পানি দে...।’ শুনে দীন যেন সংবিৎ ফিরে পান। ডাক দেন, ‘আমিন, আমিন...’। সাড়াশব্দ নেই তাঁর। অন্ধকারে হাতড়ে আমিনের শরীরে হাত রাখেন দীন। ডাকেন, ‘আ-মি-ন ভা-ই, আ-মি-ন ভা-ই।’ না। হাতটা নাকের কাছে নেন। কোনো নিঃশ্বাস নেই। ভয়টা আরও বেশি জেঁকে বসে দীনের। এবার তাঁর পালা—ভেবেই শিউরে ওঠে শরীর। তিন দিন পার হয়ে গেল। আমিন ভাইয়ের কথা মনে আনতে চান না। অসহনীয় গরম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পরনের লুঙ্গি আর জামা খুলে উত্তপ্ত লোহার পাটাতনে জট পাকিয়ে নেন। সেই জট পায়ের তলায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন দীন। উপায় খুঁজতে থাকেন। কনটেইনারের চার দিক হাত দিয়ে ধরে দেখেন। না, শুধু লোহার দেয়াল। হঠাৎ দরজায় লোহার উঁচু-নিচু অংশে হাত পড়ে তাঁর। একটু নরম কিছু হাতে লাগে। রাবারের মতো মনে হচ্ছে। এবার আঙুল দিয়ে সেই রাবার খুঁটতে থাকেন তিনি। আঙুলে জোর নেই। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সেই ফাঁক দিয়ে আবছা-আবছা দেখা যায় বাইরে। ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে শীতল বাতাস নাকে আসে। ছিদ্র বরাবর মুখ রেখে চিৎকার করতে থাকেন দীন। কিন্তু সে চিৎকার কারও কানে পৌঁছায় না।
চার কি পাঁচ দিন পেরিয়ে গেছে। দীনের চিৎকার করার শক্তি নেই। ছিদ্র ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন তিনি। হঠাৎ ছিদ্র দিয়ে পানির ফোঁটা চোখে পড়ল। একটু পরেই ছিদ্র বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। দীন বুঝতে পারেন, বৃষ্টির পানি। লোহার জং মেশানো কয়েক ফোঁটা পানি লুঙ্গি দিয়ে চিবিয়ে মুখে নেন তিনি। দীন বলছিলেন, ‘বৃষ্টির পানির কয়েক ফোঁটা মুখে নেওয়ার পর মনে হয়েছে, গলাটা একটু ভিজেছে। আবছা আবছা আলোয় কাউকে দেখছিলাম না। শরীরে তখন নড়াচড়া করার শক্তি নেই। হাত দিয়ে নিজের মুখ ও মাথায় চুল ধরে টানি। কোনো ব্যথা নেই। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ি।’
তারপর হঠাৎ একদিন। রাতে কনটেইনার নড়াচড়ার শব্দে উঠে বসেন দীন। আবার বেঁচে থাকার আকুতি। কনটেইনারে কুড়িয়ে পাওয়া লোহার টুকরো দিয়ে এবার সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে চলেন।
দীন বলেন, ‘কনটেইনারের দরজায় আঘাত করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছে, এবার কেউ এগিয়ে না এলে বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, শুধু আঘাত করতে থাকি।’ একসময় হাত থেকে পড়ে যায় লোহার টুকরো। কনটেইনারের মেঝেয় ঢলে পড়েন তিনি। তারপর হঠাৎ চোখ তুলে দেখেন, খুলে গেছে কনটেইনারের দরজা।
স্বপ্নের দেশে
হ্যানসা কালিডোনিয়া জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুই হাজার ৬৬৮ কিলোমিটার দূরে সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌঁছায় চার দিন পর। জাহাজটি সব কনটেইনার সিঙ্গাপুরে বন্দরে নামিয়ে রাখে। দীনের কনটেইনারটি পাসির পানজাং টার্মিনালে পড়ে থাকে আরও পাঁচ দিন। নয় দিনের মাথায় সেই কনটেইনার থেকে দীনকে উদ্ধার করা হয়।
দীন বলেন, ‘উদ্ধার হওয়ার পর হাসপাতালে তিন দিন ছিলাম। আমি কোথায়, তা তখনো জানি না। সিঙ্গাপুরের নামও কখনো শুনিনি। হাসপাতালে কলকাতার সেই নারী আমাকে নানা প্রশ্ন করেন। এরপর বাংলাদেশি একজন লোক (মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তা) এসে জানতে চান, কোন দালালের মাধ্যমে আইছি। কত টাকাপয়সা গেছে। আমি বললাম, “আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। কিছুই জানি না।” আমার কথায় বিশ্বাস করে না তারা। তবে আমার সঙ্গে কোনো খাবার না থাকায় তারা আমার কথায় বিশ্বাস করে।’
তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান দীন ইসলাম। মর্গে পড়ে থাকে আল-আমিনের লাশ। পুলিশ দীনকে হাসপাতাল থেকে দাতব্য সংস্থা ট্রানজিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু-এর (টিডব্লিউসি) কাছে হস্তান্তর করে। দীন ইসলামকে নিয়ে তখন হইচই শুরু হয়। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক বাংলার কণ্ঠ-এর সম্পাদক এ কে এম মোহসীন ও দেবী ফারডাউস দীনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। আল-আমিনের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত শেষ হওয়ার পর দীনের দেশে আসার সুযোগ তৈরি হয়। তত দিনে তিনি সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পরিচিতি পান। তাঁকে দেখার জন্য প্রবাসীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। দীনের দেশে ফেরত যাওয়ার কথা শুনে বিদায় সংবর্ধনারও আয়োজন করেন তাঁরা। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া দীনকে একটি ব্লেজার উপহার দেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দীনের সহযোগিতার জন্য মোট ৫০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুর থেকে বিদায় নেওয়ার আগে দীন প্রবাসীদের কাছে অঙ্গীকার করতে ভোলেননি। তিনি বলেন, ‘কখনো মাদক নেব না বলে কথা দিয়েছি বাংলার ভাইদের (প্রবাসীদের)।’
দীন ইসলামের ঈদ
আর কোনো দিন মা-বাবা, ভাইবোনের দেখা পাবেন কি না এটা নিয়েই সংশয় ছিল তাঁর।্রঈদ তো পরের কথা। তাই মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা দীন ইসলামের কাছে এবারের ঈদুল আজহাটা ভিন্ন রকম আমেজ বয়ে এনেছে। চট্টগ্রাম নগরের বিশ্বকলোনির বাসাটিতে খুশির ফোয়ারা বয়ে গেছে ঈদের কদিন।্র‘আমি তো ভেবেছিলাম জীবন এখানেই শেষ। আবার যে দেশে ফিরতে পারব, মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করব—এটা ভাবতেই পারিনি। তাই ঈদটি এবার খুব আনন্দে কেটেছে।’ বললেন দীন ইসলাম। বিশ্বকলোনির বাসাটিতে মা-বাবাকে নিয়ে থাকেন সবার ছোট দীন ইসলাম। বড় ভাই বেলাল মিয়াও থাকেন পাশের একটি বাসায়। তবে ছোট ভাই ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে ফিরে আসায় এবার ঈদ সবাই মিলেই করেছেন। বেলাল বলেন, ‘এবার দুটি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। ভাই ফিরে আসায় মা-বাবা খুব করে বলেছেন ঈদটি ভালোভাব্র্রেউদ্যাপন করতে। ’ বাবা শামসুল হক এখন রোগাক্রান্ত। কথা বলতে পারেন না। তবে তাঁর মুখেও ছিল হাসির ঝিলিক। মা সাঈদা বেগম তো বলেই ফেললেন, ‘আল্লাহর কাছে শোকরিয়া। আমার দীন ফিরে এসেছে। তাই আমাদের ঈদ খুব আনন্দেই কেটেছে।’ টানা ছয় মাস সিঙ্গাপুরে কাটিয়ে দীন ইসলাম দেশে আসেন গত ২০ অক্টোবর। এত দিন পরও দীন ইসলাম যেন পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। কয় দিন আগে রাস্তায় কনটেইনার দেখলে ভয় পেয়ে যান। ভুলতে পারেন না সেই প্রাইম মুভার চালকের কথা। টং গো ইয়ান। তিনিই তো তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দীন বলেন, ‘ওই ভাই আমাকে জীবন দিয়েছে। আমার তো কিছু করার নেই, শুধু দোয়া করা ছাড়া। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment