বনের ভেতর দিয়ে চলছে তেলবাহী ট্যাংকার, মালবাহী কার্গো
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মাস পাঁচেক আগে উত্তর-পূর্ব সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে একটি নৌ-রুট চালু করেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এখন প্রতিদিন এই পথে ২৫ থেকে ৩০টি তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো চলাচল করছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বলছে, বনের এই অংশটির কয়েকটি এলাকা বাঘ, হরিণ এবং সংশ্লিষ্ট নদী ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। তাই তারা এই পথে জাহাজ চলাচল বন্ধের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর এবং বন্দরসংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পূর্ব পাশ (বনের বাইরে) দিয়ে ঘাসিয়াখালী খাল ধরে মংলা-বরিশাল-চট্টগ্রাম রুট। কিন্তু ঘাসিয়াখালী খালে পলি জমায় সম্প্রতি এ রুটের জাহাজগুলোকে বনের ভেতর দিয়ে সরাসরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এর জন্য বন বিভাগের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।
বন আইন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভেতরের নদীগুলোতে প্রবেশ করতে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। সেখানে ভারী নৌযান চলাচলও নিষিদ্ধ। এই অবস্থায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিআইডব্লিউটিএকে একাধিকবার এবং সরাসরি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এই রুট বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে।
বন মন্ত্রণালয়ের চিঠি থেকে জানা যায়, তারা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে রায়েন্দা-শাপলা-হরিণটানা-চাঁদপাই হয়ে নৌযান চলাচলের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরের সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল হয়েই চলাচল করছে জাহাজগুলো।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য সুন্দরবনের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বিশ্ব-ঐতিহ্যের গৌরব বহনকারী এই বনটির মাটি ও পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। দ্রুতগতির এই ভারী যানগুলো চলার সময় সৃষ্ট বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ের নরম মাটিতে। এতে ভাঙছে পাড়। জাহাজের শব্দ আতঙ্কিত করে তুলছে অভয়ারণ্যের বন্য প্রাণীগুলোকে।
প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল বা কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গোগুলো বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নিয়েই সুন্দরবনের পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকাগুলো দিয়ে চলাচল করছে। বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, কিন্তু তারা এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান সামসুদ্দোহা এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগর দিয়ে মংলার দিকে আসা নৌযানগুলো ঘাসিয়াখালী খাল দিয়ে যাতায়াত করত। খালটি পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযানগুলোকে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘খুব শিগগির আমি ওই এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছি। ঘুরে এসে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।’
বর্তমানে ব্যবহূত সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল রুটটির হরিণটানা, বগী, চাঁদপাই, জয়মণিরগোল এলাকাটি হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। এটি এমন একটি এলাকা, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে কম জায়গায় সবচেয়ে বেশি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণের জন্য বিখ্যাত।
এই রুটের দুধমুখী, রায়েন্দা ও সন্ন্যাসী এলাকাটি গাঙ্গেয়, ইরাবতীসহ চার ধরনের ডলফিনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র। সরকার এই স্থানটি ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এর ভেতর দিয়েই এখন জাহাজ চালানো হচ্ছে।
গত ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বন বিভাগ জানায়, তেল ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গোগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় হাইড্রোলিক হর্ন বাজাচ্ছে। এতে হরিণসহ দুর্লভ প্রাণীর দল দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। তাদের স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ ও জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, তেল ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো সুন্দরবনের ছোট খাল ও নদীতে চলাচল করায় উঁচু ঢেউ তৈরি হচ্ছে। এতে বনের খাল ও নদীর দুই পাড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এতে শরণখোলা ও বগী বন ফাঁড়ির বেশির ভাগ স্থাপনা দ্রুত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
বন বিভাগ চিঠিতে বলেছে, তেলবাহী ট্যাংকারগুলো থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য সুন্দরবনের পানি ও মাটি দূষিত করে তুলছে। এতে বনের বিপুলসংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বড় বড় নৌযান চলাচল করায় সুন্দরবন এলাকার জেলেরা নদীতে জালও ফেলতে পারছেন না।
এরপর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত আপত্তি জানায়।
নিউইয়র্কভিত্তিক সংগঠন ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসসি) সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোর ওপর একটি প্রাথমিক সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ছয় মাস ধরে তেল ট্যাংকারগুলো ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে, কার্গো ১৫ থেকে ২৫, বিদেশি জাহাজ ২০ থেকে ৩০ এবং স্পিডবোট ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে। এই যাতায়াতের ফলে সেলা, পশুর নদ ও ঢাংমারী খালের পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনে ২ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত ভেঙে গেছে। বন্য প্রাণীর বিচরণ ও খাদ্য গ্রহণে সমস্যা হচ্ছে বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল ইসলাম সুন্দরবনের স্বার্থে নৌযানগুলোকে কিছুটা ঘুরে হলেও বিকল্প পথ দিয়ে যাতায়াতের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও সংবেদনশীল। তাই তেল বা অন্য কোনো বর্জ্য বেশি পরিমাণে জমা হলে বনের এমন ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে, যা আর কখনো পোষানো যাবে না। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment