১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে বলিভিয়ার জঙ্গলে হত্যা করা হয়। বিপ্লবী চে গুয়েভারা চোখ বুজলেন, কিন্তু তাঁর সাহস ও আদর্শ ছড়িয়ে গেল আলোর মতো দিকে দিকে। দ্রোহ আর তারুণ্যের প্রতীকে পরিণত হয়ে অক্ষয় পরমায়ু লাভ করলেন অগণিত জনের হূদয়ে। অমর এ বিপ্লবীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জন্মভূমি লাতিন আমেরিকা থেকে বহুদূর এই বাংলাদেশে তাঁর অনুরাগীরা গতকাল শনিবার আয়োজন করেছিলেন এক স্মরণ অনুষ্ঠান।
বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে ‘চে সংহতি’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চের জীবন ও আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা, আবৃত্তি ও সংগীতের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
বিশ্বের সব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন চে। তিনি মনে করতেন, একজন বিপ্লবীর কোনো সীমান্ত থাকে না। আলোচক ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক এ কথার সঙ্গে আরও বলছিলেন, আদর্শগত দিক থেকে মাও সেতুং বা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিল থাকলেও তাঁদের সঙ্গে চের একটা বড় পার্থক্যও ছিল। মাও বা ফিদেল বিপ্লবের পরে তাঁদের নিজ দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদন করেছিলেন। কিন্তু চে এক দেশে বিপ্লব সম্পন্ন করে ছুটে গেছেন অন্য দেশে। সে কারণে বিপ্লবী চে-ই একমাত্র বিশ্ববিপ্লবী। তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন।
আহমদ রফিক আরও বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতেও তরুণদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিপ্লব বা সংগ্রামের পরে যে কঠিন পরীক্ষা, তাতে আমরা প্রত্যাশিত জয় পাইনি। স্বার্থপরতা, লোভ আমাদের রাজনীতিকে দূষিত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে চের বিপ্লবী আদর্শে তরুণসমাজ উদ্দীপ্ত হয়ে জাতিকে তাঁর প্রত্যাশিত বিজয়ের সোপানে নিয়ে যেতে পারে।’ এ জন্য তিনি ‘চে সংহতি’কে একটি জোরদার সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে সারা দেশে তরুণদের সংগঠিত করার আহ্বান জানান।
এর আগে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ চে গুয়েভারার বিপ্লবী জীবনের বিশেষ দিকগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, যে মার্কিন গোয়েন্দাদের নির্দেশে চেকে হত্যা করা হয়েছিল, আজ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কেন্দ্রের প্রতীক ওয়াল স্ট্রিটে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা তুলে ধরেছেন চে গুয়েভারার ছবি। চে এক অসমাপ্ত বিপ্লবের নাম, চে এক বিপ্লবের অন্তহীন তৃষ্ণা।
সচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন চে গুয়েভারা। অধ্যয়ন করেছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্র। সুখে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের সময় তিনি সাধারণ মানুষের যে ভয়ংকর দুর্দশা দেখতে পান, বিশেষ করে গুয়াতেমালায় সিআইএ যেভাবে বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করে তা চেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে তোলে। স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছেড়ে শোষিত, মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। কিউবায় বিপ্লব করে চে চলে যান আফ্রিকার কঙ্গোতে এবং সেখান থেকে ফিরে বলিভিয়ায়। সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বিপ্লবী চের পঠন-পাঠন ছিল প্রচুর। তিনি ছিলেন কবিতার নিবেদিত পাঠক। মৃত্যুর সময় প্রিয় কবিতার যে ডায়েরিটি ছিল তাঁর কাছে, সেখানে থাকা পাবলো নেরুদার একটি কবিতার বাংলা অনুবাদ আবৃত্তি করেন সাজ্জাদ শরিফ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শ্রোতাদের স্বাগত জানান শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ সাল থেকে চে সংহতি ৯ অক্টোবর চের মৃত্যুদিনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এবার ৯ অক্টোবর এই মঞ্চ অন্য একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য আগাম বরাদ্দ থাকায় এক দিন আগে চের স্মরণানুষ্ঠান করা হলো।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রলেতারিয়েত’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন জাহীদ রেজা নূর। চেকে নিয়ে বিদেশি কবিদের কবিতার অনুবাদ আবৃত্তি করেন পারভেজ চৌধুরী। এরপর ছিল গানের পালা।
উন্মুক্ত মঞ্চের কাঠামোর সঙ্গে বিশাল ডিজিটাল প্রিন্টের পর্দায় ছিল সেই অতিচেনা ছবি—তারকাখচিত টুপি মাথায় দেওয়া ঝাঁকড়া চুলের সুদূরে নিবদ্ধ দৃষ্টির বিপ্লবী চে। পাশেই লেখা তাঁর প্রিয় উক্তি, ‘হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিওমপ্রে’, পাশেই বাংলায় লেখা তার অর্থ: ‘বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো’। সেই উক্তিকে মূলভাব করে চেকে নিয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে গান করলেন মৃত্তিকার শিল্পীরা—‘বিজয়ের পথে যাও অনাদিকাল’। তাঁদের অন্যান্য গানের মধ্যে ছিল, সংবিধান নিয়ে ‘আমরা শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষ ভীষণ নাখোশ হলেন’; ‘হারিয়ে যাওয়ার দিন হাত বাড়ায়’—এসব। উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘হে মহামানব, একবার এসো ফিরে, আহ্বান কৃষক মজদুর ভাইসব’। গানগুলো উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল শ্রোতাদের। Prothom alo
0 comments:
Post a Comment