না, এডমুন্ড হিলারি আর তাঁর সহযোগী তেনজিং নরগের এভারেস্ট জয়ের মুহূর্তটার ছবি আঁকা হয়নি। এতক্ষণ যা পড়লেন, অনেক ব্রিটিশের মনে এই ছবিটা আঁকা আছে অন্য দুজনের নামে। তাঁরা মনে করেন, হিলারি আর তেনজিং এভারেস্ট জয়ের প্রায় ৩০ বছর আগে সর্বোচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গে পা রেখেছিলেন দুই ব্রিটিশ। ১৯৫৩ নয়, এভারেস্ট জয় করা হয়েছিল ১৯২৪ সালেই। আর এভারেস্টে পা রাখা প্রথম দুই কীর্তিমান হলেন জর্জ ম্যালরি ও অ্যান্ড্রু আরভিন।
ব্রিটিশদের কেউ কেউ এখনো মানতে নারাজ হিলারি আর তেনজিংয়ের কীর্তি। কিন্তু ম্যালরি আর আরভিন যে এভারেস্ট জয় করেছিলেন, এর দালিলিক প্রমাণ নেই। ওই অভিযানেই নিহত হন এই দুজন। তাঁদের অভিযানের অগ্রযাত্রার সর্বশেষ যে খবরটি পাওয়া গিয়েছিল তাতে জানা যায়, ম্যালরি-আরভিন নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে ছিলেন। কিন্তু এরপর প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। চরম আবহাওয়ায় দুজনই নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয় এই প্রশ্নের উত্তরও—এই ঝড়ে পড়ার আগেই কি এভারেস্টে পা রাখতে পেরেছিলেন তাঁরা?
এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়। তৈরি হতে থাকে একের পর এক তত্ত্ব। একসময় সেই আলোচনা থিতিয়েও আসে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এক অভিযানে ম্যালরির দেহাবশেষ উদ্ধার করা হলে নতুন করে উসকে ওঠে আলোচনার আগুন। কিন্তু ম্যালরি-আরভিনের সঙ্গে থাকা ক্যামেরাটি সেবার পাওয়া যায়নি। ফলে মীমাংসা হয়নি রহস্যেরও।
অমীমাংসিত এই রহস্য নিয়ে আবারও শুরু হয়ে গেছে আলোচনা। আগামী ডিসেম্বরে নতুন এক অভিযান শুরু হচ্ছে। এই অভিযানে চেষ্টা করা হবে আরভিনের মৃতদেহ উদ্ধারের। চেষ্টা করা হবে তাঁদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরার ফিল্ম খুঁজে বের করার। অক্ষত অবস্থায় সেই ফিল্ম পাওয়া গেলে হয়তো মিলে যাবে উত্তর—প্রথম এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব আসলেই হিলারির, নাকি ম্যালরি বা আরভিনের? এভারেস্টে পা রাখলে নিশ্চয়ই কিছু ছবি তুলে রেখেছিলেন তাঁরা!
১৯২১ সালে পরীক্ষামূলক একটি প্রস্তুতি অভিযান চালানো হলেও এভারেস্ট জয়ের প্রথম পরিকল্পিত অভিযান নেওয়া হয় আসলে পরের বছর। সেই অভিযান ব্যর্থ হলে ১৯২৪ সালে নেওয়া হয় আরও একটি অভিযানের উদ্যোগ। এই তিন অভিযানের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন ম্যালরি। ১৯২৪ সালে তাঁর বয়স ছিল ৩৭। এই অভিযানকেই নিজের এভারেস্ট জয়ের শেষ সুযোগ মনে করতেন তিনি। আর এ কারণে ম্যালরি ছিলেন মরিয়া। তাঁর ক্লাইম্বিং পার্টনার আরভিনের বয়স কিন্তু ছিল মাত্র ২২।
সুদর্শন ম্যালরি ছিলেন কেমব্রিজের প্রভাষক। পর্বত অভিযানের সবচেয়ে আলোচিত বচনের জন্মদাতাও তিনি। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি ঠিক কোন কারণে এভারেস্ট জয় করতে চান? ম্যালরির সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ‘বিকজ, ইটস দেয়ার।’ বয়সে ম্যালরির চেয়ে ১৫ বছরের ছোট আরভিন ছিলেন প্রকৌশলের ছাত্র। ‘কথা কম কাজ বেশি’ নীতিতে বিশ্বাসী। ধৈর্যশক্তি আর একনাগাড়ে পরিশ্রম করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতার কারণেই ১৩ জন অভিযাত্রী দলের মধ্যে সবচেয়ে কম অভিজ্ঞ হওয়ার পরও সঙ্গী হিসেবে তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন ম্যালরি।
এখনকার অভিযাত্রীদের জন্য কল্পনার বাইরে সব প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্রপাতি নিয়েই এই অভিযানে গিয়েছিলেন তাঁরা—বারবেরির তৈরি গ্যাবার্ডিনের জ্যাকেট, হোঁৎকা পেরেক লাগানো বুটজুতা, প্রথম প্রজন্মের অক্সিজেন সিলিন্ডার। দলের বাকি সবাই ফিরে এলেও অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে ঠিকই এগিয়ে গেছেন এই দুজন। এই অভিযানের খবর নিয়মিত ছাপা হচ্ছিল টাইমস-এর পাতায়। সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁদের এভারেস্ট জয়ের খবর পড়ার জন্য। কিন্তু ১৯২৪ সালের অভিশপ্ত ৮ কিংবা ৯ জুন মারা যান তাঁরা।
শেষ পর্যন্ত আসলেই কী হয়েছিল, তা জানার উপায় নেই। তবে দুটি কারণে অনেকেই ধারণা করেন, ম্যালরি-আরভিন সত্যিই এভারেস্টে পা রেখেছেন। প্রথম কারণটি হলো, ম্যালরি সব সময় তাঁর পকেটে স্ত্রীর ছবি রাখতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, এভারেস্ট জয়ের পর সেখানেই স্ত্রীর ছবিটি রেখে আসবেন। ম্যালরির মৃতদেহের সঙ্গে ছবিটি না পাওয়া যাওয়ায় ধারণা করা হয়, এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথেই আসলে মৃত্যু হয় তাঁদের। দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়, ম্যালরির গগলসটি পাওয়া গিয়েছিল তাঁর পকেটে। চোখের বদলে পকেটে গগলসটি থাকার কারণে সন্দেহ করা হয়, সন্ধ্যার কিছু পর ম্যালরি আর আরভিন একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
এসব তত্ত্ব বাজারে চলে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক জমে ওঠে, হিলারি আর তেনজিংকে কি আসলেই কৃতিত্ব দেওয়া যায় প্রথম এভারেস্টজয়ী হিসেবে? বিতর্কের শেষ টেনে দেন খোদ ম্যালরির ছেলে জন ম্যালরি। তিনি বলেন, এভারেস্ট জয় মানে শুধু এর চূড়ায় পা রাখা নয়, সফলভাবে সেখান থেকে নেমে আসাও।
তবে ‘জর্জ ম্যালরি’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এভারেস্ট জয় করেছিলেন! না, এই জর্জ ম্যালরি নয়; ১৯৯৫ সালে তাঁর নাতি জয় করেন এভারেস্ট। দাদুর সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম রাখা হয় জর্জ ম্যালরি! এভারেস্টের চূড়ায় জর্জ ম্যালরি তাঁর দাদুর একটা ছবি রেখে আসেন, যে ছবিতে লেখা ছিল, ‘আনফিনিশড বিজনেস!’
—রাজীব হাসান, বিবিসি অবলম্বনে
0 comments:
Post a Comment