দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, আপলোড করার সমস্যা নেহাত কারিগরি বা অনবধানতাবশত। এখানে গুরুতর কোনো অনিয়ম ঘটেনি। তবে জ্বলন্ত প্রশ্ন, বিজেএসের দাবি অনুযায়ী যে ১২০ জনের নামের তালিকা জাতির সামনে পেশ করা হয়েছে, সেখানে কি সততা ও নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটেছে?
সেটা ঘটেছে বলা কঠিন। কারণ, ভয়ানক অস্বচ্ছতাই শুধু নয়, এখানে এমনকি সুপরিকল্পিত অসততা বা কারসাজির ঘটনাও দৃশ্যমান। কারণ তারা দাবি করেছে, ১২০ জনের রোল নম্বর মেধাক্রমানুসারে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা বিভিন্ন ধরনের কোটাও মেধাতালিকার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। কোন রোল নম্বরগুলো কোন কোটায় উতরালো, তাও গোপন রাখা হয়েছে। আর সেটা যাতে জনগণ ধরতে না পারে, সে জন্য কমিশন দৃশ্যত ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। তারা মনোনীত ব্যক্তিদের নামধাম গোপন রেখেছে। শুধু তাঁদের রোল নম্বর প্রকাশ করেছে। এভাবে তারা জনগণের জানার অধিকার হরণ করেছে। এটা যে একটা বড় ধরনের লুকোচুরি, সেটা কমিশন-সংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। কারণ কমিশনের সদস্যরা এর আগে ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া সফর করেছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন, এই বিচারক নিয়োগে প্রাথমিকভাবে মনোনীত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণ যাতে ভবিষ্যৎ বিচারকদের বিষয়ে আগেই জানতে পারে। বাংলাদেশে এটা যাতে চালু হয়, সে জন্য তাঁরা সরকারের কাছে সুপারিশ রেখেছেন। আর নিজেরা যখন মনোনীত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করছেন, তখন যতটা সম্ভব গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন।
আসল কথায় আসি। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মনোনীত ৩০ জনের মধ্যে প্রায় ২০ জনই মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। ২৫ সেপ্টেম্বর কমিশনকে তথ্য আইনে চিঠি দিয়েছি। সচিব বলেন, চেয়ারম্যান পূজার ছুটিতে। ফিরে বৈঠক করবেন। কমিশনের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মো. জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাই। তিনিও খোঁজ নিয়ে আমার চিঠির দোহাই দিলেন। সচিব এ বিষয়ে তথ্য দিতে অপারগতা জানান।
গোটা জাতি এমনিতেই একটা ভয়ংকর কোটার ফাঁদে খাবি খাচ্ছে। ২০০৮ সালে পিএসসির উদ্যোগ ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটার ওপর সমীক্ষা হয়েছে। আকবর আলি খান ও কাজী রকিব উদ্দীন আহমাদ দেখিয়েছেন, কোটা কীভাবে মেধাবীদের কোণঠাসা করছে, জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাতে বেশ মনে হচ্ছে, আমাদের জনপ্রশাসনের রসাতলে যাওয়ার জন্য বল্গাহীন কোটা বহুলাংশে দায়ী।
বিচার বিভাগে মহিলা কোটা প্রবর্তনে অনেকে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের দোহাই দেন। কিন্তু সেটা তথ্যনিষ্ঠ নয়। ওই রায়ের মূল ১২ দফা নির্দেশনা লিখেছিলেন বিচারপতি মোস্তাফা কামাল। চার নম্বর দফায় বিচারক নিয়োগে তিনি শুধু মেধাকেই পূর্বশর্ত দেন। তবে বলেন, বিচারক নিয়োগে নারী ও পুরুষের যাতে সমতার লক্ষ্য পূরণ হয়, সেদিকে নজর রাখতে। কিন্তু পরে আপিল বিভাগের ২০০৭ সালের বিধি অনুমোদনে ত্রুটি ঘটে। সেখানে নারীর জন্য বিশ ভাগ কোটা রাখা হয়। এমনকি বলা হয়, যদি মেধায় তাঁরা না আসতে পারেন তাহলেও যেন মোট শূন্য পদের ২০ ভাগ নিশ্চিত করা হয়। তবে সুখের বিষয়, একজন নারীরও কোটা লাগেনি। আমাদের মেধাবী নারীকুল অনন্য যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
ইতিমধ্যে দাবি উঠল, সরকারি চাকরির সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা থাকলে বিচার বিভাগ বাদ থাকবে কেন। এর পরের ধাপে হয়তো হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগেও ৩০ ভাগের দাবি উঠবে। তবে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করলেও উতরানো ও নারীদের ২০ ভাগের স্থানে ১০ ভাগ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কমিশনের ২০১০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের ৩৭ পৃষ্ঠার বিবরণ অনুযায়ী বিধি সংশোধনের বিষয়টি কমিশনের সুপারিশে আইন মন্ত্রণালয় হয়ে আপিল বিভাগে অনুমোদিত হয়েছে। এতে লেখা আছে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালের নিয়োগ বিধিমালায় কতিপয় সংশোধনী আনতে কমিশনের সভায় সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। তৎপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আপিল বিভাগে মাসদার হোসেন মামলার অংশ হিসেবে ওই খসড়া অনুমোদনের প্রার্থনা করে। মাননীয় আদালতের আদেশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিধিমালার অধিকতর সংশোধনক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, মহিলা, উপজাতি ও জেলার জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়।’ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তখন ছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান। আমরা জেনেছি, ফেল করাদের বিচারক বানানোর তত্ত্ব কমিশন দেয়নি। তবে সরকারি প্রস্তাবে আপিল বিভাগ সায় দিয়েছেন। এটা সত্যি হলেও স্বাধীন কমিশন দায় এড়াতে পারে না। কারণ তারা ভিন্নমত বা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হননি।
তবে নারীর প্রতি বিশেষভাবে সদয় হয়েও আবার বিমুখ হওয়া আমাদের আপিল বিভাগ নতুন করে কোটা কণ্টকেই আমাদের বিদ্ধ করলেন। এতে মাসদার হোসেন মামলার চার দফা রক্তাক্ত হলো। কারণ, সেখানে বিচারক নিয়োগে শুধু মেধার কথাই ছিল। কোটার কথা ছিল না।
উপরন্তু বাংলাদেশ সংবিধানের কোনো সমর্থন কিংবা উচ্চ আদালতের এমন কোনো রায় ছিল না, যার ভিত্তিতে আপিল বিভাগ নিঃশর্তে ৩০ ভাগ কোটা সৃষ্টির সরকারি প্রস্তাবে সায় দিতে পেরেছিলেন। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাসহ যারাই অনগ্রসর, তাদের কোটাভুক্তির যৌক্তিকতা আমরা অস্বীকার করি না। প্রজাতন্ত্রের সব চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বিবেচনায় কোটা থাকবে, বিচারকদের থাকবে না, সেই যুক্তির জোরও বোধগম্য।
তবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই সমাজের উঁচুতে ওঠা দলিত শ্রেণীর সন্তানদের ‘ক্রিমি লেয়ার’ বা তেলতেলে স্তরভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ কেউ দলিতমাত্রই কোটাসুবিধা পাবে না। তেমনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানমাত্রই কোটাসুবিধা প্রাপ্য হতে পারে না। তা ছাড়া ফেল করলেও কোটা পূরণ করতে হবে, এটা কে কবে শুনেছেন? পিএসসির অন্য কোনো চাকরিতে ফেল করলে চাকরি মেলে না। কোটা খালি থাকে। এখন যদি মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য সন্তানেরা যুক্তি দেন, পিএসসিতে আমরা ফেল করে কোটা পাইনি। তাহলে বিজেএস পরীক্ষায় ফেল করেও কেন বিচারক হওয়া যাবে। বিগত বিএনপি আমলে পিএসসির চাকরিতে ফেল করলে পদ শূন্য রাখার বিধান তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার যথার্থই তা পুনর্বহাল করেছে। এর ফলে পিএসসি আগের মতোই ফেল করা ছেলেমেয়েদের দিয়ে কোটা পূরণ করে না। আগের মতোই পদ শূন্য রাখে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টও উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দিয়ে কোটা পূরণ না হলে ফেল করাদের জামাই আদর করেননি। পিএসসির মতোই পদ খালি রাখার উপায় বাতলেছেন। কোটার পদ খালি থাকে টানা তিন বছর। কিন্তু ফেল করা কারও ঠাঁই হয় না।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ে যেখানে নারী-পুরুষে সমতার কথা বলা হয়েছিল, সেখানে তাদের ২০ ভাগ কোটা ১০ ভাগে হ্রাস করা হয়। সরকারের অন্যান্য চাকরিতে মহিলাদের জন্য ১০ ভাগ কোটা, তাই এখানেও ১০ ভাগ করার যুক্তিটা যান্ত্রিক। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর গুলশানের হ্রদের ধারের নতুন বাড়িতে কথা হলো। প্রাসঙ্গিক আলাপচারিতায় আমার মনে হলো, এই বর্ষীয়ান আইনবিদ সম্ভবত ঠিকই মনে করেন, বিচারাসনে নারীর প্রাধান্য ঘটলে দেশে দুর্নীতি কিছুটা কমত। সেদিক থেকে গত ডিসেম্বরে নেওয়া আপিল বিভাগের সংশোধিত সিদ্ধান্ত নারীর প্রতি এক ছলনাই বটে। ১০ ভাগ মেধায় টিকে গেলে তাদের জন্য কোটা প্রযোজ্য হবে না। নারীর জন্য এমন বিধান করা এক ভাঁওতা। কারণ এ পর্যন্ত কমিশনের নেওয়া পরীক্ষাগুলোতে নারীরা ২০ ভাগের বেশি এসেছেন মেধার জোরে। কোটা তাঁদের লাগেনি। মুক্তিযোদ্ধারা জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম হয়ে তাঁদের সন্তানরা ৩০ ভাগ কোটা পেলেন, আর নারীরা জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ হয়ে পেলেন ১০ ভাগ।
আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেননি। যাঁরা নিয়েছেন তাঁরা সবাই কোটার মতো সুবিধা পেতে ব্যগ্র, সেটা ধরে নেওয়া যাবে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যখন বলেন, অন্তত মেধার হার হতে হবে ৫০ ভাগ। তখন আমাদের আপিল বিভাগ অনুমোদন দেন ৫৫ ভাগ কোটার। আর ৪৫ ভাগ মেধার। এ তো গ্রহণযোগ্য নয়।
শুনেছি, তথ্য অধিকার আইনে এর আগে এক প্রার্থী পরীক্ষার ফল জানতে চাইলে কমিশন গোপনীয়তার পক্ষেই অবস্থান নেয়। ফলাফল প্রকাশে পিএসসির ঢাক গুড়গুড় নীতি প্রসঙ্গে ড. আকবর আলি খানের পর্যবেক্ষণ উল্লেখযোগ্য। তাঁর কথায়, ‘গোপনীয়তার অবগুণ্ঠন কোটা সংক্রান্ত সব বিচ্যুতি ও ভ্রান্তিকে ঢেকে রাখে। তাই সংক্ষুব্ধরা প্রতিকারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে না।’ এ নীতি পরিত্যজ্য।
আমরা আকবর আলি খানের সঙ্গে একমত যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য কোটা সংরক্ষণের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। ১৯৮৪ সালে পিএসসির পরীক্ষায় ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৭ ভাগ প্রার্থী কৃতকার্য হন। ১৯৮৬ থেকে ’৯০ সালে এটা দাঁড়ায় শতকরা ১ ভাগে। ১৯৯৭ সালে এই কোটা নতুন প্রাণ পায় যখন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য এটা চালু করা হয়। জুডিশিয়াল সার্ভিসে ফেল করাদের দিয়ে কোটা পূরণের বহর দেখে মনে হয় ধারাটা পিএসসি থেকে আলাদা নয়।
পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসেইন বললেন, এটা তো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ধারণাকেই ধূলিসাৎ করে। প্রয়োজনে আগে থেকেই পাস মার্ক কমানো যেতে পারে। কিন্তু ভাইভায় ফেল মানে তো ফেল। অধ্যাপক জাকির হোসেনও একমত হন। আমরা আশা করব, কমিশন তার সুপারিশ বাতিল করে পুরো বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mৎkhanbd@gmail.com মিজানুর রহমান খান প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment