শান্তিপূর্ণ এ নির্বাচনে আলোচিত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বেসরকারিভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। চাষাঢ়ার শহীদ জিয়া হলে গত রাত ১২টা ৪৭ মিনিটে আইভীকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। তিনি জানান, ১৬৩টি কেন্দ্রের পুরো বেসরকারি ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট (দোয়াত-কলম)। নিকটতম প্রার্থী সরকারি দল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শামীম ওসমান পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট (দেয়ালঘড়ি)। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও তিনি পেয়েছেন সাত হাজার ৬১৬ ভোট (আনারস)।
সকাল আটটায় শুরু হয়ে টানা বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। মোট ভোটার চার লাখ চার হাজার ১৮৯ জন। ভোট পড়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ৫৯২ বা ৬৯.৯২ শতাংশ। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ছয় হাজার ২৫৪ ভোট।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইভী বলেছেন, ‘এ জয় জনতার, এ জয় খেটে খাওয়া মানুষের।’ তাঁর ভাষায়, ’৫২, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০ সালে যেমন জনতার বিজয় হয়েছিল, তেমনি গতকালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের বিজয় হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারের সময় আইভী বলেছিলেন, তিনি আরেক ’৭৪-এর আশা করেন। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৪ সালে। সেই নির্বাচনে জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা আলী আহম্মদ চুনকা চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পান খোকা মহিউদ্দীন। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন আইভীর বাবা চুনকা। ৩৭ বছর আবার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো।
চুনকার মেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক টানাপোড়েনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় বিতর্কিত শামীম ওসমানকে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষ চুনকার মেয়েকেই ভোট দিয়ে ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনল। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থাকাকালে ২০০৩ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আইভী। টানা আট বছর তিনি এই পদে ছিলেন।
মেয়র পদে মোট ছয়জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলেও কার্যত প্রার্থী ছিলেন তিনজন। এই তিনজনের মধ্যে বিএনপি-সমর্থিত তৈমুর আলম খন্দকার সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় ভোটের সাত ঘণ্টা আগে সরে দাঁড়ান।
তবে সেনাবাহিনী মোতায়েন না হলেও গতকাল ভোটের দিন মোট সাড়ে চার হাজার পুলিশ, এক হাজার ৪০০ র্যাব এবং এক হাজার ৫০০ আনসার সদস্য মোতায়েন ছিলেন। ভোট গ্রহণ ছিল শান্তিপূর্ণ।
সরেজমিন: তিন থানা—সদর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়ে গঠিত এই সিটি করপোরেশনের ১৬৩টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৮০টি কেন্দ্র ঘুরেছেন প্রথম আলোর ১৫ জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী। সারা দিন সর্বত্র ছিল ভোটের উৎসব। এ উৎসবে বড় ভূমিকায় ছিলেন নারী ভোটাররা। দুজন আটক ও দু-একটি কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমানের মারমুখী আচরণের কারণে সামান্য উত্তেজনার ঘটনা বাদ দিলে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে সকাল আটটার আগেই নারী ও পুরুষ ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। সিদ্ধিরগঞ্জের অনেক কেন্দ্রে সকালবেলায় ভোটারের উপস্থিতি ছিল অপেক্ষাকৃত কম।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোর বাইরে ও ভোটার সারিতে দাঁড়ানো বেশির ভাগের বুকে ও গলায় ঝুলছিল শামীম ওসমানের প্রতীক ‘দেয়ালঘড়ি’র ব্যাজ। সর্বত্র ঝুলছিল ওই প্রার্থীর পোস্টার। দুপুরের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, বাইরে শামীমের ব্যাজ ধারণ করে বুথের ভেতরে গিয়ে মানুষ ভোট দিচ্ছেন আইভীকে। ততক্ষণে আইভীর বিজয়ও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শামীম ওসমানের আচরণে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুপুর ১২টা থেকে তিনি গণমাধ্যমের ক্যামেরা দেখলে খেপে উঠছিলেন। সাড়ে ১২টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দলবল নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেন তিনি। পুলিশ বাধা দিলে তিনি চার-পাঁচজনকে নিয়ে প্রবেশ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে একজন কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। ওই প্রার্থী শামীমের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর সঙ্গে সকালে পুলিশ দুর্ব্যবহার করেছে। এ কথা শুনে পুলিশের দিকে তেড়ে যান শামীম। দুর্ব্যবহারের কৈফিয়ত চান। পুলিশ উল্টো কাউন্সিলর প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা বলেন। এ পর্যায়ে শামীম ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির কাছে ফোন করে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং ফোনটি কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দেন। এরপর পুুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কির সময় সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে গেলে শামীম ‘এই ক্যামেরা সর’ বলে ধমক দেন। সাংবাদিক বাড়তে থাকলে তিনি দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যান। বেলা পৌনে দুইটার দিকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনের রাস্তায় তোলারাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতিকে মারধর করেন তিনি।
কাল দিনভর সহস্রাধিক গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যবেক্ষক তৎপর ছিলেন নির্বাচনী এলাকাজুড়ে। ভোটার তালিকায় নামে গরমিল, ভোট গ্রহণের গতি ধীর হলে কিংবা কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আলামত দেখামাত্র ভোটাররা ছুটে গেছেন সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের কাছে। কোথাও কোনো আশঙ্কার কথা শুনলে দ্রুত ছুটে গেছে র্যাব-পুলিশের টহল দল।
সিদ্ধিরগঞ্জের প্রায় সবগুলো এবং শহরের অনেক কেন্দ্রে আইভীর নির্বাচনী এজেন্ট ছিল না। আইভী অভিযোগ করেন, আগের রাতে এজেন্টদের হাত-পা কেটে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে তাঁর এজেন্টরা কেন্দ্রে যাননি।
জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সবার সহযোগিতায় উৎকৃষ্ট একটি নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ রইল না। এ জন্য তিনি গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান।
সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় ‘সন্ত্রাস ও কারচুপি’র আশঙ্কায় ভোট বর্জনকারী বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারও রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় আমি খুশি।’
আর আইভী আগেই বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের জনতাই হবে আমার সেনাবাহিনী।’ সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সেই জনতা ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য আইভী নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
একটি অভিযোগ: শহরের এবিসি স্কুল কেন্দ্রে চরম অব্যবস্থাপনা ছিল। কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি থাকলেও অনেক বহিরাগতকে ওই কেন্দ্রে ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে। বিশৃঙ্খলার কারণে ভোট দিতে অনেক সময় লাগছে বলে জানান ভোটাররা।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কক্ষে এক বহিরাগতকে জানালার পাশে সিগারেট খেতে ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তার চেয়ারের উল্টো পাশের চেয়ারে আরেকজন বহিরাগতকে বসে থাকতে দেখা য়ায়। বহিরাগতের পরিচয় জানতে চাইলে নাম বলেন মোমিনুল ইসলাম মঞ্জু। পরিচয়পত্র ছাড়া এখানে কী করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি স্যারের ব্যক্তিগত স্টাফ।’
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রেজাউল করিম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি যুব উন্নয়নের কর্মকর্তা। মঞ্জু আমার এমএলএসএস।’
পরিচয়পত্র ছাড়া মঞ্জু এখানে কী করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল বলেন, ‘আমার কাজে আমি তাঁকে নিয়ে এসেছি।’ পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’
বহিরাগতদের ব্যাপারে পুলিশের উপপরিদর্শক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানি না যে এখানে বহিরাগত ঢুকেছে।’
অন্যদিকে স্কুলের নারী কেন্দ্রে সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত কোনো প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। এই কেন্দ্রটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সেলিনা হায়াৎ আইভী আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছিলেন।
দুজন আটক: মরগান বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে সুনয়ন মাহমুদ ও মোরশেদুল ইসলাম নামের দুজনকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আটক করেন। তাঁরা কেন্দ্রে ঢুকে শামীম ওসমানের পক্ষে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সিদ্ধিরগঞ্জে নানা অভিযোগ: সিদ্ধিরগঞ্জে আদমজী নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমডব্লিউ উচ্চবিদ্যালয়, পাইনাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাতেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিজমিজি পাইনাদী সিনিয়র (ফাজিল মাদ্রাসা) কেন্দ্রে পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও র্যাব ও আর্মড পুলিশ অনেক দূরে অবস্থান করছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। শামীম ওসমানের লোকজন ব্যাজ পরে কেন্দ্রে অবাধে আসা-যাওয়া করছেন। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই আইভীর এজেন্ট ছিল না।
সিদ্ধিরগঞ্জে বিদ্যুৎ উন্নয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ভোটার উপস্থিতি একেবারে নেই। তবে প্রচুর পুলিশ, র্যাব ও আর্মড পুলিশ ছিল।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, আইভীর এজেন্টরা আসেননি, তালিকাও জমা দেননি। অপর প্রার্থীর এজেন্টদের অবাধে ঘোরাফেরা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রত্যাহার: সিদ্ধিরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাহমুদ শাহকে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একজন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়।
{সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কামরুল হাসান, টিপু সুলতান, শেখ সাবিহা আলম, তানভীর সোহেল, হারুন অর রশিদ, শরিফুল হাসান, আনোয়ার হোসেন, আসিফ হোসেন, মনির হোসেন}
0 comments:
Post a Comment