সিলভি রবার্ট ও অ্যালেইন ডেগ্রে ছিলেন ফ্রিল্যান্স ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। ফরাসি এই দম্পতি আশির দশকের শেষের দিকে গিয়েছিলেন আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে; ছবি তুলতে। সেই আফ্রিকাতেই নামিবিয়ার রাজধানী উইন্ডহোকে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তান। আলফ্রেড হিচককের দ্য বার্ডস ছবির অভিনয়শিল্পী টিপ্পি হেড্রেনের নামানুসারে সেই মেয়ের নাম তাঁরা রাখেন টিপ্পি ডেগ্রে।
একদিকে কোলজুড়ে এল মেয়ে, অন্যদিকে চলতে থাকল পশুপাখি ক্যামেরায় ধরে রাখার কাজ। সেই কাজের জন্য সিলভি ও অ্যালেইনকে চষে বেড়াতে হলো আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল। মেয়ে টিপ্পি বেড়ে উঠতে লাগল একদম প্রকৃতির কোলেই। তার বন্ধু হলো বনের কিছু পশুপাখি। খেলার জায়গা হলো বিশাল ঘাসবন, মরুভূমি কিংবা ঠাসবুনোটের ঝোপঝাড়। মাথার ওপর ছাদ হলো উদার জমিনের সুনীল আকাশ।
মা সিলভি বলছিলেন মেয়ে টিপ্পির বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা, ‘আফ্রিকায় একেবারে অন্য রকম একটা শৈশব কাটিয়ে এসেছে মেয়েটা। সেটা ছিল একটা জাদুর দুনিয়া, সেখানে সত্যিকারের আনন্দ পেয়েছিল সে।’ কে দিয়েছিল সেই আনন্দ? প্রকৃতি তো বটেই, বিশেষ কয়েকটি নামের কথা না বললেই নয়। একটা বেজি ছিল টিপ্পির বন্ধু, সেটিই ছিল টিপ্পির প্রথম আফ্রিকান বন্ধু, নাম ছিল ওকানতি। বন্ধু ছিল ২৮ বছরের হাতি আবু। চিতাবাঘ জেঅ্যান্ডবিও ছিল খুব কাছের। এ ছাড়া ছিল আস্ত একটা কুমির! ছিল আদুরে এক সিংহের ছানা, জিরাফ, গালাগো, উটপাখি, মিরক্যাট। খাতির ছিল একটা বাচ্চা জেব্রা, ভেড়া, সাপ ও আফ্রিকান ধূসর তোতাপাখির সঙ্গে। আর ছিল পেটমোটা ব্যাঙ ও বহুরূপী এক গিরগিটি!
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই বুনো পশুপাখিকে বন্ধু মেনেছিল টিপ্পি। পশুপাখিও ছোট্ট মানুষটিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুত্বের শুঁড়, ঠোঁট, ডানা কিংবা থাবা!
শুধু পশুপাখিই নয়, টিপ্পি বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল বুশম্যান ও কালাহারির হিম্বা আদিবাসীদের সঙ্গে। সোনালি চুলের মেয়েটিকেও আপন করে নিল আফ্রিকার মানুষগুলো। টিপ্পির একেকটা দিন কাটতে লাগল বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, যে অভিজ্ঞতা কেবলই আনন্দের। এই সকালে দেখা গেল হাতি আবুর পিঠে সওয়ার হয়েছে টিপ্পি, তার পরই দেখা গেল কুমিরটার সঙ্গে দুটো কথা বলে আসতে। দুপুরে আবার বুশম্যানদের সঙ্গে শিকার শিকার খেলায় ব্যস্ত! বিকেলে বাচ্চা জেব্রাটাকে নিজ হাতে দুধ না খাওয়ালেই নয়। সূর্য যখন পাটে যেতে বসেছে, দেখা গেল উটপাখির পিঠে করে হেলেদুলে ফিরে আসছে সে মা-বাবার কাছে! মুখে রাজ্যজয়ের হাসি।
মোটকথা, আফ্রিকায় সত্যিকারের একটা মুগলি আবিষ্কার করলেন সিলভি-অ্যালেইন দম্পতি। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের দ্য জাঙ্গল বুক-এর ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তাঁদের চোখের সামনে। সেই চিন্তা থেকেই হয়তো সত্যিকারের মুগলি, মানে মেয়ে টিপ্পি ও তার বন্ধুদের প্রতিদিনের জীবন ক্যামেরায় ধরে রাখতে শুরু করলেন সিলভি ও অ্যালেইন। আলাদা করে কিছুই করতে হলো না তাঁদের। যা করার করল টিপ্পি নিজেই। পশুপাখির সঙ্গে দোস্তি তো তার হামাগুড়ি দেওয়ার বয়স থেকেই। তার ওপর এরই মধ্যে বুশম্যান ও হিম্বা আদিবাসীদের ভাষাও রপ্ত করেছে সে! শিখেছে তীর ছোড়ার কায়দা-কানুন। আর তার পোশাক-আশাক? কিপলিংয়ের মুগলি তাকে দেখলে লজ্জাই পেত! বুশম্যানদের মতো সংক্ষিপ্ত নেংটিতেই মেয়েটি দুর্দান্ত। এদিকে পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া একরাশ সোনালি চুল। পোড় খাওয়া তামাটে চেহারা, চোখে বুনো চঞ্চলতা। মোটামুটি গাট্টাগোট্টা শরীর। এর চেয়ে ভালো সত্যিকারের মুগলি আর কোথায় মেলে?
টিপ্পি যখন ফ্রান্সে
আফ্রিকায় তোলা সত্যিকারের মুগলি টিপ্পির ছবিগুলো নিয়ে একটা বই বেরোল একদিন। নাম—টিপ্পি: মাই বুক অব আফ্রিকা। বিশ্বের ১৪টি দেশে প্রকাশিত হলো তা। হইচই পড়ে গেল চারপাশে। বেশ নামডাক হলো টিপ্পির। দেশ-বিদেশের নামজাদা পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে থাকল তার ছবি আর খবর। কিন্তু টিপ্পির মন ভালো নেই। কী হলো প্রাণচঞ্চল ফুটফুটে মেয়েটির? মেয়েটিকে বন্দী করা হলো খাঁচায়! হ্যাঁ, আফ্রিকা যদি হয় উন্মুক্ত প্রান্তর, ফ্রান্সের প্যারিস খাঁচাই বটে।
১৯৯৯ সালের বড়দিনের কথা। সিলভি-অ্যালেইন বড়দিন উদ্যাপনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গেলেন মাদাগাস্কারে। কিন্তু সেখানে দিন কতক থাকতে না থাকতেই মেয়ের চোখ ছলছল, ‘মা, আমি ওকান্তিদের কাছে যাব!’ মেয়ের কথা ভেবে সেখান থেকে দ্রুতই পাততাড়ি গোটালেন সিলভি ও অ্যালেইন। কিন্তু এর মধ্যে একদিন ফরাসি একটি টিভি চ্যানেল আমন্ত্রণ জানাল টিপ্পিকে, সঙ্গে ওর মা-বাবাকেও। সত্যিকারের মুগলির একটা সাক্ষাৎকার চাই তাদের। তা-ই হলো, মেয়েকে নিয়ে প্যারিসে এলেন সিলভি-অ্যালেইন।
প্যারিসের বাতাসে কী ছিল কে জানে! মেয়ের সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হওয়ার কদিন যেতে না যেতেই সিলভি ও অ্যালেইন সিদ্ধান্ত নিলেন, বিচ্ছেদ চাই তাঁদের! দীর্ঘ ২৫ বছরের পথচলা থমকে গেল। আর সেই সঙ্গে টিপ্পি হারাল আফ্রিকার জীবন!
সেই সময়ের কথা বলছিলেন সিলভি, ‘টিপ্পির বয়স তখন ১০। তখন সে আমাদের বিচ্ছেদের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছে। এবং সেই সঙ্গে আবিষ্কার করল, আফ্রিকা থেকেও সে বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছে, যেমনটা হয়েছিল ওর বাবার সঙ্গে।’ আফ্রিকা ও বাবা, দুই সত্তার সঙ্গে যুগপৎ বিচ্ছেদ, টিপ্পির তখন কেমন লেগেছিল? সেই অনুভূতি সহজেই অনুমেয়। মা সিলভি দেয়ালে ঝোলানো মেয়েটার বিমর্ষ একটা ছবির দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘প্রথম দিকে কোনোমতেই প্যারিসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি মেয়েটা। সব সময় ওর আফ্রিকার বন্ধুদের কথা বলত ও! বুকটা ভেঙে যেত তখন।’ কী বলত টিপ্পি? ওর ওয়েবসাইটে লিখেছিল, ‘এখানে তো আমি আকাশটা দেখতে পাই না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি যেন খাঁচায় বন্দী।’
মেয়েকে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত করে তুলতে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন মা। কিন্তু নাহ্, স্কুলে কোনো বন্ধুর খোঁজ পেল না টিপ্পি। সারাক্ষণ চোখ-মুখ কালো। পড়াশোনায়ও মন নেই। দুই বছর চেষ্টা করেও স্কুলে মন টেকাতে না পেরে বাড়িতেই চলতে লাগল পড়াশোনা। চিন্তিত মা। একসময় ধরেই নিলেন, এই মেয়ে সময়-সুযোগ পেলেই ফের আফ্রিকায় ছুটে যাবে।
মায়ের ধারণা সত্যি হয়েছিল। প্রথম দিকে খুব কষ্ট হলেও শেষমেশ প্যারিসের শহুরে জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে টিপ্পি। পরে সে ভর্তি হয়েছে প্যারিসের লা সরবনে নভেলে ইউনিভার্সিটিতে। এখনো সে সেখানেই পড়ছে। পড়াশোনার বিষয় ফিল্ম মেকিং। পুঁথিগত বিদ্যা এরই মধ্যে কাজে লাগিয়েছে টিপ্পি। এবং কাজের ক্ষেত্র সেই আফ্রিকা! হ্যাঁ, ফের আফ্রিকায় ফিরে গিয়েছিল টিপ্পি। ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য সে তৈরি করেছে ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র।
কদিন আগে, ৪ জুন ছিল টিপ্পির জন্মদিন। এখন ওর বয়স ২১ বছরের খানিকটা বেশি। টিপ্পির বিচরণক্ষেত্র এখন প্যারিসের শহুরে পথ। টিপ্পি প্রতিদিন সূর্যটাকে হারিয়ে যেতে দেখে বড় দালানকোঠার আড়ালে। টিপ্পি পাখির ডাক শোনে না অনেক দিন। টিপ্পির মন পড়ে থাকে সেই আফ্রিকায়। তার পরও সত্যিকারের মুগলি এখন শহুরে মানুষ। বছর কতক আগে ওকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘তোমার জাতীয়তা কী?’ ওর দ্বিধাহীন উত্তর ছিল, ‘আফ্রিকা!’ এখনো একই উত্তর দেয় টিপ্পি, ‘আমার দেশ আফ্রিকা!’
রিডার্স ডাইজেস্ট অবলম্বনে মাহফুজ রহমান
প্রথম আলো..
0 comments:
Post a Comment