জাতীয় পতাকা জড়ানো কফিনটি খানিক পরপরই ঢেকে যাচ্ছিল ফুলে ফুলে। তাই আগেরগুলো নামিয়ে রাখা হচ্ছিল পাশে, পরেরজনকে পুষ্প নিবেদনের জায়গা করে দিতে। কফিনের খানিক অংশ খোলা। মুদিত নয়ন পপগুরুর মুখ দেখা যাচ্ছিল শুধু। সেদিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে অনেকেই ধরে রাখতে পারেননি চোখের পানি। চোখ মুছতে মুছতে সরে গেছেন সামনে থেকে।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় পপসম্রাট আজম খানের মরদেহ নেওয়া হয়েছিল শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। কফিনবাহী গাড়িটি আসার আগেই শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ ভরে উঠেছিল জনসমাগমে। ফুল, ভালোবাসা, অশ্রু ও শ্রদ্ধায় এক মহাকাব্যিক বিদায়। মৃত্যুকে ছুঁয়ে যেন নতুন জীবন লাভ করলেন বাংলাদেশের পপগানের সম্রাট আজম খান।
এর আগে সকাল সাড়ে ছয়টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে আজম খানের মরদেহ কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডের বাড়ির সামনে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গত রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আশপাশের এলাকার হাজারো মানুষ ছুটে যান সেখানে। সূর্যের আলো ফুটতেই পুরো এলাকা জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং তাঁর অনেক গুণগ্রাহীর কান্নায় এলাকায় বিষাদময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এখানেই তাঁর প্রথম জানাজা পড়ানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে দেওয়া হয় ‘গার্ড অব অনার’। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।্রএরপর মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্বের সড়ক এবং আশপাশের এলাকা জনসমাগমে ভরে উঠেছিল। বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজা হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে। এর আগে সবাই যেন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন, সে জন্য পাঁচটি লাইন করা হয়েছিল। সুশৃঙ্খলভাবে, ধীর কদমে এগিয়ে এসে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। আগের নির্ধারিত সময় ছিল এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা পরও লাইন শেষ হচ্ছিল না। খররোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন অনেকে। ওদিকে জানাজার সময় হয়ে আসছিল। সে কারণে দুপুর সোয়া ১২টায় কফিন তুলে নেওয়া হলো মঞ্চ থেকে। যাঁরা কাছে আসতে পারেননি, দূর থেকেই অন্তরের নিখাদ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন; চিরশান্তি কামনা করেছেন প্রিয় শিল্পীর আত্মার।
শহীদ মিনারে প্রথম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের পক্ষে তাঁর একান্ত সচিব ফজলুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর বিশেষ সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, বিএনপির পক্ষে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আজম খানের কফিনে ফুল দেন।
পুরো সময় শিল্পীর কফিন ঘিরে ছিলেন সংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ফকির আলমগীর, আব্দুল জব্বার, খুরশীদ আলম, হানিফ সংকেত, আইয়ুব বাচ্চু, কাজী হাবলু, আগুন, রবি চৌধুরী, কুদ্দুস বয়াতি, আজাদ আবুল কালাম, গোলাম কুদ্দুছ, হাসান আরিফসহ বহু শিল্পী ছুটে আসেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মরহুমের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোট, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী, সুরের ধারা, প্রজন্ম ’৭১, মুক্তিযোদ্ধা চেতনা পরিষদ, গ্রাম থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, গণফোরাম, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সেলিম আল দীন স্মৃতি পরিষদ, মিউজিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, আজিমপুর ওল্ড ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন, খেলাঘর কেন্দ্রীয় সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় গীতিকবিতা পরিষদ, নারী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি, ছাত্র ইউনিয়ন, এটিএন বাংলা, বৈশাখী টেলিভিশন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ চিকিৎসক সমিতি, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা অফিসার্স ক্লাব, শহীদ আসাদ পরিষদ। সব শেষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। প্রয়াত গায়কের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিকতা। শোকগাথা আয়োজনটির ধারাবর্ণনা করেন জোটের সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর আজম খানের মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। বাদ জোহর দ্বিতীয় দফায় জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। কবর নিয়ে এখানে একটু জটিলতা দেখা দেয়। কবরস্থানের উত্তরাংশে যে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে মূলত স্থানীয় বাসিন্দারা এলাকার কেউ মারা গেলে দাফন করে থাকেন। সে কারণে এ স্থানটি নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। পরে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বেলা সোয়া তিনটায় বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মাঝখানে একটি জায়গা নির্ধারণ করে কবর তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুরোধে তৃতীয়বার জানাজা পড়ানো হয় এখানে।
পড়ন্ত বেলায় শিল্পীকে শায়িত করা হয় চিরশয্যায়। সময় তখন বিকেল সাড়ে চারটা। কবরস্থানেও জনসমারোহ বিপুল। প্রিয় শিল্পীর শবানুগামীদের বেদনাই জানিয়ে দিয়েছিল, দেহান্তর মানেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নয়। পপগুরু বেঁচে থাকবেন অগণিত ভক্তের অন্তরে।
0 comments:
Post a Comment