২/ সব কিছুরই রয়েছে সৌন্দর্য- কিন্তু, খুব কম লোকই তা দেখতে পায়।
৩/ যারা মিতব্যায়ী নয়- তারা আজ হোক, কাল হোক ভুগবেই।
৪/ অজ্ঞতা হল মনের রাত্রি। যে রাত্রি চন্দ্রশূন্য, নক্ষত্রশূন্য ।
৫/ ভবিষ্যৎকে মুঠোয় নেওয়ার জন্য অতীতকে বিশ্লেষন কর।
তাঁর জন্ম প্রাচীন চিনে হলেও বিশ্বের মানুষ আজ তাঁকে চেনে মানবসভ্যতার একজন অন্যতম শ্রেষ্ট জ্ঞানী মানুষ হিসেবে। আজও চিন-তাইওয়ান ও হংকং আপামর জনসাধারণ আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে এই জ্ঞানী মানুষটির জন্মবার্ষিকী আনন্দ উৎসব সহকারে পালন করে।
কনফুসিয়াসের ৫ নং উক্তিটি খেয়াল করুন। এখানেই আমরা চিন থেকে আলাদা। কেননা, Study the past if you would define the future. এই -কথাটাই আমরা জানি না। জানলেও মানি না। কেননা, আমাদের দেশের ইতিহাস আড়াই থেকে তিন হাজার বছর পুরনো। অথচ মাত্র ৪০ বছরের ইতিহাস নিয়ে আমাদের বিভ্রম আজও দূর হল না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে মুঠোয় নেওয়ার জন্য আমরা আমাদের অতীতকে বিশ্লেষন করলাম না। অথচ,Study the past if you would define the future.- এই কথাটি কনফুসিয়াস বলেছিলেন যিশুর জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে!
৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে ২৯ আগস্ট কনফুসিয়াসের জন্ম প্রাচীন চিনের লু প্রদেশের চৌ গ্রামে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। বাবা ছিলেন লু প্রদেশের গরিব সৈন্য, কাজেই টানাটানির সংসার। কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন-তখন তার বাবা মারা যান। পরিবারটির অবস্থা চরমে উঠল। মার মুখ কালো; থমথমে।
যা হোক। কনফুসিয়াসের পড়ালেখা কিন্তু আটকাল না। মার ইচ্ছে ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখবে। কনফুসিয়াসের মা ছিলেন অসাধারণ এক নারী । নৈলে ছেলে পরবর্তীকালে অত বড় মানবতাবাদী হল কি করে? বড় হয়ে কনফুসিয়াস বলেছিলেন-Forget injuries, never forget kindnesses.
আহ্।
মা না শেখালে ছেলে অমন শিক্ষা পেল কোত্থেকে ?
মা বলত, “অজ্ঞতা হল মনের রাত্রি বাছ। যে রাত্রি চন্দ্রশূন্য, নক্ষত্রশূন্য । তোর মনের আকাশে যেন নিত্য পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে বাছা, তারারা ঝিলমিল করে জ্বলে।”
এমনি প্রজ্ঞাবন ছিলেন সেই মহিলা। শত অভাবের মাঝেও প্রায়ই ছেলেকে ডেকে বসিয়ে বলতেন, আমাদের দেশের প্রাচীন ঋষিরা ছিলেন মহৎ। প্রাচীন ঋষিদের উপদেশ মেনে চলাই পাপ আর অধঃপতন থেকে বাঁচার এক মাত্র পথ বাছা।
অনুমান করি, সংসারের নড়বড়ে কাঠামোটি একাই ঠেকিয়ে রেখেছিলেন ওই প্রাজ্ঞ নারীটি। অনুমান করি-জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও রসিক মাটিকে ভারি ভালোবাসত মেধাবী ছেলেটি।
মাকে সাহায্য করা জন্য অস্থির হয়ে উঠল কনফুসিয়াস। কিশোর বয়েসে প্রথমে কাজ জুটল স্থানীয় একটি বাজারের দেখাশোনার। পরে এক ধনী প্রতিবেশির খামারে। দিনভর খামারের বাগান, বাগানের গাছপালা পশুপাখি দেখাশোনা করত কিশোর।
… নির্জন প্রহর কাটত।
আসলে কনফুসিয়াস ছিলেন মেষপালক। জগতের আলোকপ্রাপ্তরা অনেকেই ছিলেন মেষপালক।
সব কিছুর প্রতিই কেমন এক তীব্র কৌতূহল বোধ করত কিশোর। এমন কী নিজের শরীরের প্রতিও। বড় হয়ে কনফুসিয়াস যে কারণে বলেছিলেন-“ সব কিছুরই রয়েছে সৌন্দর্য- কিন্তু, খুব কম লোকই তা দেখতে পায়।” মেয়েদের শরীরের প্রতিও,অনুমান করি, কনফুসিয়াসের ছিল এক অফুরন্ত কৌতূহল । মা জ্ঞানী ছিলেন বলেই ঠিকই বুঝলেন ছেলের অস্থিরতা। মেয়ে এক প্রকার ঠিক করেই রেখেছিলেন। বিয়ের ব্যবস্থা করলেন ছেলের। কনফুসিয়াসের তখন ১৯ বছর বয়েস। প্রদীপের আলোয় বউয়ের নগ্ন নরম হলদে শরীরটি দেখে মুগ্ধ হল সদ্য কৌশরোর্ত্তণ তরুন; তারপর বউয়ের নরম শরীরটি ছেনেছুনে পুরুষালি কৌতূহল মেটাল। কামের তৃষ্ণা মিটাল। যথাসময়ে দুটি কন্যা ও একটি পুত্র হল কামের ফসল হিসেবে।
বয়স কুড়ি হলে মা বললে, ছেলে মেয়ের বাপ হয়েছিস। এবার ভালো চাকরি খোঁজ। জীবনভর রাখাল হয়ে থাকবি নাকি শুনি? তোকে অত কষ্ট করে পড়ালেখা শেখালাম কেন?
ঘোরলাগা তরুনের মনে তখন চৈতন্যের উদয় হল।
লু প্রদেশের এক কর্মকর্তার সচিবের চাকরি জুটে গেল সামান্য তদবিরের পর।
সুখে দিন কাটছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭। মা মারা গেলেন। গভীরতরো এক শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল কনফুসিয়াস। হায়। কেউ জানল না-আমার আমার গুরুর মৃত্যু হল।
দিন কাটে শোকে। মাথায় নানান প্রশ্ন। বউয়ের আদর ভালো লাগে না। চাকরি ভাল লাগে না। চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতার কাজ নিল। মাকে গভীর ভাবে ভালোবাসত। মায়ের জন্য এতকাল লু ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি।
এবার ভ্রমনে বেরুবে বলে ঠিক করল।
তাঁর বউ আর তিন ছেলেমেয়ের কী হল-চৈনিক ইতিহাসবিদের লিখেন নি।
ক্রমে ক্রমে জ্ঞানী মানুষ হিসেবে তাঁর নাম ছড়াল।
তাঁর সময়ে চিন শাসন করত চৌবংশের ( ১০২৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৫৬ খ্রিস্টপূর্ব) রাজারা। তখন সামন্তবাদ ক্ষয়ে যাচ্ছিল। সামন্তবাদী আদর্শ ধ্বসে পড়ছিল। সরকারি মহলে প্রবল নৈতিক অধঃপতন; চারিদিকে থিকথিক করছিল ঘুষখোর দূনীর্তিবাজরা। কনফুসিয়াসের বিরাজমান অধঃপতনের তীব্র সমালোচনা করলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল প্রাচীন ঋষিদের সহজ-সরল জীবন ও আর্দশ মেনে চললেই পাপ আর অধঃপতন থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে। এই কারণে প্রাচীনকালে লিখিত গ্রন্থ থেকে নানা উপদেশ পাঠ করে শোনাতে লাগলেন কনফুসিয়াস।
চিনে তখন দার্শনিক লাও-ৎ সের তাওবাদ ভীষন জনপ্রিয়। দার্শনিক লাও-ৎ সে সমাজই মানতে চান না। লাও-ৎ সে ‘তাও তে চিং’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর বইয়ের ১৯ নং অধ্যায়ে লাও-ৎ সে লিখেছেন-
And it will be a hundred times better for everyone.
তাঁর কথা কেউ শুনল, কেউ-বা শুনল না।
কিন্তু, তাঁর তত্ত্বের প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছিলেন কনফুসিয়াস। মাঝ বয়েসে লু প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। শোনা যায় তাঁর প্রশাসন নাকি নানা দিক দিয়ে সফল হয়েছিল। নানাবিধ সংস্কার কর্মসূচী গ্রহন করেছিলেন কনফুসিয়াস। রাজ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অপরাধ হ্রাস পেয়েছিল।
এক দল লোক তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছিল। ষড়যন্ত্র ভালো লাগবে কেন শান্তিপ্রিয় ওই মানুষটির। কাজেই, সরকারী দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।
আবার পথে নামলেন।
চিনকে বদলাতে হবে।
মায়ের স্বপ্ন ছিল সঠিক জ্ঞানভিত্তিক এক সুখি চিন।
জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানের আলোয় মনের অন্ধকার দূর করতে হবে।
কেবল ভোগী যুবরাজরা তাঁর কথায় কান দেয়নি। কেননা, তারা মনে করত তাদের জন্ম হয়েছে মেয়েদের নিয়ে বাগানবাড়িতে ফূর্তি করার জন্য। মেয়েদের একচ্ছত্র মালিকানা নিয়ে কখনও কখনও বিরোধে জড়িয়ে পড়ত তারা। কনফুসিয়াস তখন তাদের বলতেন-“প্রতিশোধ নিতে যাওয়ার আগে দুটি কবর খুঁড়ো।”
ভোগী যুবরাজরা নাক সিটকাতো।
কনফুসিয়াস তাদের বলতেন-‘ভবিষ্যৎকে মুঠোয় নেওয়ার জন্য অতীতকে বিশ্লেষন কর।’
ভোগী যুবরাজরা নাক সিটকাতো।
চিনকে আমূল বদলে দেওয়ার জন্য তেরো বছর চিনের এখানে ওখানে ঘুরলেন।
ভোগী রাজপুরুষগন তার কথা শোনে না। তবু তিনি তাদের বললেন- ” If you governed your province well and treat your people kindly, you kingdom shall not lose any war. If you govern selfishly to your people, you kingdom will not only lose a war, but your people will break away from your kingdom.”
কনফুসিয়াস লু-তে ফিরে এলেন। ওখানে মায়ের কবর।
ওখানেই মারা যান। ৭২ বছর বয়েসে।
লু রাজ্যটা বর্তমানে শাঙডনে। আজও শাঙডনের নির্জন কুঙ অরণ্যের ভিতর তাঁর কবরটি রয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লোকে এখনও যায় ওই কবরের কাছে। নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। নির্জনতায় স্মরণ করে মানবজাতির শ্রেষ্ট এক শিক্ষককে। যিনি বলতেন-”A man should practice what he preaches, but a man should also preach what he practices.”
না। কনফুসিয়াস নিজে কিছু লিখে যান নি। তাঁর জীবনের বানী Analects
নামে বইয়ে লিখিত। কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর Analects বইটি শিষ্যরা লিখেছিল।
ফুজি মানে শিক্ষক। চিনেরা কনফুসিয়াসকে বলে স্রেফ-মাস্টার কং।
আরও একটা কথা। মাস্টার কং অসম্ভব গানের পাগল ছিলেন।
আর চিন বানানটা ঠিকই আছে। বিদেশি বানান সবই -ি কার হবে।
0 comments:
Post a Comment