হারমনি স্পার রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকেই সৌন্দর্যচর্চায় আয়ুর্বেদ বা ভেষজের জ্ঞানকে কাজে লাগানো হয়েছে। এ ধরনের সৌন্দর্যচর্চা করা হয় সুস্থ, সুন্দর, নীরোগ ও দীর্ঘ জীবনের জন্য। সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক বিষয় নয়, মানসিকও বটে। ভেতর ও বাইরের চর্চা যখন এক হয়, তখনই একটি মানুষের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। আয়ুর্বেদ সে কথাই বলে।’ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক লায়লা বিনতে হোসেন জানান, আয়ুর্বেদে একদিকে রক্ত পরিষ্কারক ভেষজ খাবারের মাধ্যমে ভেতরের সৌন্দর্যকে বের করে নিয়ে আসা হয়, অন্যদিকে ভেষজ উপাদানে বাহ্যিক সৌন্দর্যচর্চাও করা হয়। এভাবেই সন্ধান মেলে স্থায়ী সুন্দরের।
আপনার ব্যস্ত জীবনের মাঝখান থেকে খুঁজে নিন একটু অবসর, এ অবসরটুকু হোক একান্তই আপনার ত্বকের ও মনের সৌন্দর্যের। আয়ুর্বেদের নানা পদ্ধতি নানাভাবে কাজ করে। এর কৌশল জানিয়েছেন রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা।
কর্মমুখর নগরে ঘরে বসে থাকার সুযোগ কোথায়! আর বাইরে বের হলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পালানোরও উপায় নেই। এ কারণে হাত-পা, শরীরের ত্বক কালো হয়ে যায়, কালো ছোপ ছোপ দাগ হওয়ার মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। আয়ুর্বেদে এ সমস্যার সমাধানের উপায় হলো বডি র্যাপ। এ জন্য প্রথমে পুরো শরীর স্ক্রাব করা হয়, তারপর ভেষজ উপাদানের মাস্ক দিয়ে শরীর মুড়ে দিতে হয়। মুড়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় কলার পাতা। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট এভাবে থেকে কলা পাতা খুলে দেওয়া হয়। এ কারণে রোদে পোড়া কালো দাগ থেকে সহজেই মুক্তি মেলে। আপনি চাইলে বাসায় বসে নিজে নিজে করতে পারেন এ চর্চা। স্ক্রাব হিসেবে চালের গুঁড়া, কাঁচা হলুদ, পান পাতার রস ও তিলের তেলের মিশ্রণ ব্যবহার করতে পারেন। আর গাদা ফুল, শঙ্খের গুঁড়া ও পান পাতা দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন ভেষজ মাস্ক।
উজ্জ্বল, মসৃণ ও কোমল ত্বক পেতে করতে পারেন আয়ুর্বেদের অভয়াঙ্গা। এটি হলো তেল দিয়ে ম্যাসাজ করা। এই তেল নানা রকম গাছগাছড়া, গাছের পাতার সাহায্যে জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এই তেল দিয়ে পুরো শরীর ম্যাসাজ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। আপনি অভয়াঙ্গা করতে চাইলে আয়ুর্বেদের দোকান থেকে মেডিকেটেড তেল কিনে নিয়ে ঘরে বসেও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনার একজন সঙ্গীর সাহায্য নিতে হবে।
যাঁদের শরীরে অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা করতে পারেন আয়ুর্বেদের এলাফিজি ও পদিক্ষিদি। বিভিন্ন ভেষজ পাতার সাহায্যে পুঁটলি তৈরি করে গরম ভেষজ তেলে ডুবিয়ে সারা শরীরে ম্যাসাজ করা হয়। এটি শরীরের যেকোনো ব্যথার জন্যও অনেক উপকারী। আপনি বাড়িতে রসুন ও কালিজিরা গরম সরিষার তেলে ডুবিয়ে ম্যাসাজ করলেও উপকার পাবেন।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে জুড়ি নেই আয়ুর্বেদের নভরাফিজির। ‘নভরা’ হচ্ছে একধরনের বিশেষ চাল। এই চাল বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করে পুঁটলিতে বেঁধে দুধের সঙ্গে সারা শরীরে ম্যাসাজ করা হয়। এটি হবু কনেদের জন্য খুব উপকারী। বিয়ের আগে টানা ৪০ দিন এ ম্যাসাজ করলে ত্বক উজ্জ্বল ও কোমল হয়। আপনি বাজার থেকে নভরা চাল কিনে নিয়ে ঘরে বসে নিজে নিজে এ ম্যাসাজ করলেও উপকার পাবেন।
যাঁদের শরীরে ব্যথার সমস্যা রয়েছে, তাঁরা করতে পারেন ‘পিলিচিল’। এর মানে হলো সর্বাঙ্গধারা। এই তেলের ধারা শরীরের নির্দিষ্ট স্নায়ুর ওপর করা হয়। স্নায়ুগুলো সচল করে এটি ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
চুল পড়া ও চুলের খুশকি সমস্যা নিয়ে যাঁদের রাতের ঘুম হারাম, তাঁদের জন্য আয়ুর্বেদের সমাধান হলো ‘তালাম’। এখানে ঔষধিগাছের পাতা, ফল, ফুল, গাছের ছাল দিয়ে প্যাক তৈরি করে সব চুলে লাগিয়ে ৪০ মিনিট রাখা হয়। পুরো মাথা একসময় কচু পাতা বা কলার পাতায় মুড়ে দেওয়া হয়। এটি চুলের গোড়া মজবুত করে চুলের খুশকি দূর করে ও চুল পড়া বন্ধ করে। আপনি ঘরে বসেও তালাম করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মেহেদি পাতা, নিম পাতা, দারুহরিত্রার পাতা, কয়েক ফোঁটা লেবুর রস, জবা ফুল একসঙ্গে মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে নিতে পারেন।
মানসিক চাপ কমাতে করতে পারেন আয়র্বেদের শিরোধারা। এটি ঠান্ডার সমস্যা, সাইনোসাইটিস, মাইগ্রেনের সমস্যার জন্যও অনেক উপকারী। এখানে ঔষধি তেল দিয়ে মাথার ওপর ফোঁটা ফোঁটা করে তেলের ধারা দেওয়া হয়। এ তেল দিয়েই মাথা ও ঘাড়ের ম্যাসাজ করা হয়। এটি ঘরে নিজে নিজে করা কষ্টসাধ্য। তবু যাঁরা করতে আগ্রহী, তাঁরা আয়ুর্বেদের দোকান থেকে মেডিকেটেড তেল কিনে নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
ত্বকের উজ্জ্বলতা, লাবণ্য ও আপনার মনের ক্লান্তি দূর করতে আয়ুর্বেদের স্নান খুব উপকারী। এখানে ঔষধিগাছের ছাল, ফুল, পাতা দিয়ে মাস্ক তৈরি করে পুরো শরীরে ম্যাসাজ করে ঔষধি উপাদান দিয়ে পানি জ্বাল দিয়ে গোসল করানো হয়। হবু কনেদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকরী। ঘরে বসে এটি করতে আপনি আমলকী, হরীতকী, বয়রা, স্টার অ্যানিস, গাঁদা ফুল, পান পাতা একসঙ্গে মিশিয়ে মাস্ক তৈরি করে নিতে পারেন। নিম পাতা, থানকুনি পাতা ও পান পাতা পানিতে জ্বাল দিয়ে গোসলের পানিতে মিশিয়ে নিতে পারেন।
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। সৌন্দর্যচর্চা শেষ করে এবার একটা সুষম খাদ্যাভ্যাস জরুরি, যেখানে থাকবে প্রচুর রঙিন ফল, সবজি আর পানি। আয়ুর্বেদ সৌন্দর্যচর্চায় ভালো ফল পেতে করতে পারেন যোগব্যায়াম ও ধ্যান। আপনার শারীরিক ও মানসিক সৌন্দর্যের কথা ভেবে যেকোনো আয়ুর্বেদিক চর্চা করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ, ভুল পরিচর্যায় উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কাই বেশি। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment