হুমায়ূন আহমেদ
বিগত নভেম্বরে হুমায়ূন ভাইয়ের জন্মদিনে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, শুধু জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা প্রকাশের জন্য নয়, মরণব্যাধি থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে আসার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ব্যক্ত করতে।
মা, মাটি ও মানুষের টানে একবার ফিরলেন তিনি, তবে শিগগিরই আবার চলে যেতে হলো চিকিৎসার প্রয়োজনে। কিন্তু এই মানুষটি যে এত দ্রুত না-ফেরার জগতে চলে যাবেন, তা মানতে কষ্ট হচ্ছে। মাত্র কিছুদিনের জন্য এলেন, আশাজাগানিয়া কথা বললেন। ওই সময় তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলার বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখা হলো। সেই চিরতরুণ, চিরসবুজ হুমায়ূন আহমেদ। সেদিন মঙ্গলবার বসুন্ধরা শপিং মলের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সিনেপ্লেক্স হলের বাইরে ভক্ত-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন তিনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ছিল, কিন্তু সেটি ছাপিয়ে উঠেছিল দেশের মাটিতে ফেরার আনন্দের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, যে মানুষটি বাংলাভাষী কোটি কোটি মানুষের হূদয় জয় করেছেন অবলীলায়, তিনি নিশ্চয়ই মরণব্যাধিকেও জয় করে ফিরবেন। হায় রে মরণ! আবালবৃদ্ধ বাঙালির হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হুমায়ূন আহমেদকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঝড়ের মতো! শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম, শুনলাম, চলে গেছেন আমাদের হুমায়ূন ভাই, আর ফিরবেন না তাঁর ভক্ত-স্বজনদের কাছে, প্রিয় ‘নুহাশপল্লী’তে, ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র বাসভবনে। একুশের বইমেলা চত্বরে তীর্থের কাকের মতো ভিড় করা নানা বয়সী অগণিত ভক্তকে অটোগ্রাফ দিতে আর আসবেন না হুমায়ূন আহমেদ।
বাঙালির চিন্তাচেতনায়, মেধা আর মননে তিনি যে কত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তার প্রমাণ দেখছি প্রতিনিয়ত রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা আজ হুমায়ূনময়! ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে সর্বত্র আজ হুমায়ূন ভাইয়ের জন্য প্রাণের আকুতির প্রকাশ, কেন এই বয়সে চলে যেতে হলো তাঁকে!
তরুণ-তরুণীরা রুদ্ধবাক, নগরে-বন্দরে গৃহিণীরা টেলিভিশনের সামনে বসে চোখ মুছছেন; হাটবাজারে, গ্রামগঞ্জে কর্মজীবী, মধ্যবিত্ত মানুষের আক্ষেপ, হুমায়ূন আহমেদের মতো করে আমাদের জন্য আর কে লিখবেন! বন্ধু, স্বজন, সতীর্থরা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছেন লেখক, কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কত জানা-অজানা তথ্য, ছবি আঁকার প্রতি তাঁর আগ্রহ, ম্যাজিশিয়ান হওয়ার শখ, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা, বন্ধুবাৎসল্য, মায়ের জন্য টান—কত কিছু জানতে পারছি আমরা। কিন্তু আসলেই বাংলা সাহিত্যের এই কথা-জাদুকরকে আমরা কতটুকু জেনেছি, জাতি হিসেবে তাঁর জীবদ্দশায় কতখানি মর্যাদা তাঁকে দিতে পেরেছি? একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে শত-সহস্র দেশি-বিদেশি, প্রবাসী বাঙালির সহায়তার অজস্র আশ্বাস তাঁকে আপ্লুত করেছিল, তা-ও সত্যি। প্রধানমন্ত্রীও একবার সময় করে দেখতে গিয়েছিলেন আমেরিকায় চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদকে।
সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা সেদিন তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল, তাঁর দেওয়া আর্থিক সহায়তা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অসম্ভব রকম ব্যয়বহুল চিকিৎসার অর্থ সংকুলান করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন হুমায়ূন ভাই ও তাঁর পরিবার। কিন্তু কখনো আত্মমর্যাদার সঙ্গে আপস করেননি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যখন তাঁকে জাতিসংঘ মিশনে উপদেষ্টার পদ প্রদান করা হয়েছিল, তখন তাঁর ভক্ত-স্বজনেরাই শুধু নন, তিনি নিজেও খুশি হয়েছিলেন। প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল তাঁর পরিবার। হয়তো চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশন থেকে নিয়মিত সহায়তা আসবে, হাসপাতালে যাতায়াত অথবা অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে নিদেনপক্ষে একটি গাড়ি তো পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না! হুমায়ূন ভাই যখন নিউইয়র্কের স্লোন ক্যাটারিং অথবা বেলভিউ হাসপাতালে দীর্ঘ কয়েক মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন প্রতিদিন (বিশেষ করে ফেরার সময় প্রায়ই মধ্যরাতে) বিশাল নিউইয়র্ক নগরের জ্যামাইকার ফ্ল্যাট থেকে স্ত্রী শাওন অথবা স্নেহভাজন মাজহারকে ট্রেনে দীর্ঘ চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে যাতায়াত করতে হয়েছে। হাঁটতে হয়েছে রেলস্টেশন থেকে বেলভিউ হাসপাতালের ছয় ব্লক দীর্ঘ পথ। জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের জন্য আমরা জাতিসংঘ মিশনে একটি পদের ব্যবস্থা করেছিলাম বটে, কিন্তু কোনো সম্মানী ভাতা তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারিনি! তাঁর জন্য, তাঁর চিকিৎসা-সঙ্গীদের জন্য জরুরি প্রয়োজনে কোনো যানবাহনের আয়োজন করতে পারিনি! তবে দেরিতে হলেও জুন মাসের শেষ দিকে যখন হুমায়ূন আহমেদ সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেন তাঁর পরিবারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি বাহনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ধন্যবাদ তাঁকে; শেষ সময়ে হলেও আমাদের কথা-জাদুকরের পরিবারকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের পরিবার তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী গৃহকর্মী মোস্তফাকে তাঁর সেবা-শুশ্রূষার জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিল বেশ আগে। আজও তা প্রক্রিয়াধীন আছে! অদৃশ্য কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমাদের কোনো মন্ত্রণালয়ে অথবা আমেরিকান দূতাবাসে এটি এখনো কেন আটকে আছে, জানি না। শুধু এটুকু জানি, আজ হুমায়ূন আহমেদকে আমরা যে যত শ্রদ্ধাঞ্জলিই নিবেদন করি না কেন, শেষ দিনগুলোতে তাঁর এ ধরনের ছোট ছোট প্রত্যাশাও আমরা পূরণ করতে পারিনি। কিংবদন্তি এই মানুষটি অনেক অভিমানে সেই সময় তাঁর এই সব দিনরাত্রির বয়ান করতে চেয়েছিলেন, সেই লেখার শিরোনামও দিয়েছিলেন: ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’! কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধে সেটি আর প্রকাশ করেননি। (ক্ষমা করো ভাই শাওন, তোমার বিনা অনুমতিতে আজ এগুলো লিখছি। হুমায়ূন ভাইকে যথাসময়ে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি, এ অনুতাপ শুধু আমার নয়, তাঁর কোটি কোটি ভক্ত-স্বজনেরও।)
অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদ জনমানুষের শিক্ষার জন্য যে কত আগ্রহী ছিলেন তার জাজ্বল্যমান নিদর্শন দেখেছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই শিক্ষাবিদ সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে, নিজস্ব অর্থায়নে গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি বিদ্যালয়: ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’; নিজের নামে বা মা-বাবার নামে নয়! এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কী হতে পারে।
এই মহতী আয়োজন, এই বিদ্যাপীঠটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁরই আমন্ত্রণে গত বছর শিক্ষাসচিবসহ আমরা কজন গিয়েছিলাম। জেনেছিলাম, সম্পূর্ণ নিজ খরচে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন তিনি। একপর্যায়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন এই বিদ্যায়তনটি সরকারি সহায়তা পাবে, শিক্ষাসচিব মহোদয়ও কথা দিয়েছিলেন একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আজও তা হয়নি!
হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর প্রায়ই স্কুলটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি, কিন্তু কোনো আশার সংবাদ পাইনি। শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি বারবার যখন জেনেছি নিজের চিকিৎসার ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে যে করেই হোক, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কুতুবপুরে পৌঁছে দেওয়ার কড়া নির্দেশ ছিল তাঁর।
সম্প্রতি তিনি যখন মা ও মাটির টানে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছিলেন, তখন শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের কিছু অব্যবস্থাপনা, কতিপয় শিক্ষকের কোচিং-বাণিজ্য ইত্যাদি তাঁর গোচরে আসে। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ শরীরেও তিনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন; বলেছিলেন, শিক্ষাকে যারা পণ্য বানানোর অপপ্রয়াস চালায়, তাদের তিনি ক্ষমা করবেন না। তাঁর পরিবারের হস্তক্ষেপে সেদিন ওই শিক্ষকেরা রীতিমতো থানা-পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এই জনদরদি পরিচয় আমরা কজন জানি? আশা করছি, শিক্ষাসচিব মহোদয় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠকে সহায়তা করার জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করবেন। হুমায়ূন ভাই আজ চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর এই প্রত্যাশা কি আমরা আজ পূরণ করতে পারি না? শিক্ষামন্ত্রী একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ, তিনি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদকে যথাযথ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আমরা কি পিছপা হব? নিশ্চয়ই না। তবে নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি থাকবে, যাতে আমাদের জননন্দিত, অসাধারণ এই মানুষটির স্মৃতির বাহক শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ যেন বাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসনে পতিত না হয়, স্থানীয় সুযোগসন্ধানী টাউটদের পাল্লায় না পড়ে। এটা স্থানীয় সমাজের দায়িত্ব এবং আমাদের সবারই দায়বদ্ধতা হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন প্রয়াত কালপুরুষের কাছে।
হুমায়ূন ভাই, আপনার বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে বলছি, শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ সগৌরবে এগিয়ে যাবে। আমরা তো আছি, আপনার অগণিত ভক্ত-স্বজন—আমরা আপনার স্মৃতি ধরে রাখব। চিরনিদ্রায় শান্তিতে থাকুন আপনি। সৃষ্টিকর্তা আপনার হেফাজত করুন।
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মা, মাটি ও মানুষের টানে একবার ফিরলেন তিনি, তবে শিগগিরই আবার চলে যেতে হলো চিকিৎসার প্রয়োজনে। কিন্তু এই মানুষটি যে এত দ্রুত না-ফেরার জগতে চলে যাবেন, তা মানতে কষ্ট হচ্ছে। মাত্র কিছুদিনের জন্য এলেন, আশাজাগানিয়া কথা বললেন। ওই সময় তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলার বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখা হলো। সেই চিরতরুণ, চিরসবুজ হুমায়ূন আহমেদ। সেদিন মঙ্গলবার বসুন্ধরা শপিং মলের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সিনেপ্লেক্স হলের বাইরে ভক্ত-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন তিনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ছিল, কিন্তু সেটি ছাপিয়ে উঠেছিল দেশের মাটিতে ফেরার আনন্দের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, যে মানুষটি বাংলাভাষী কোটি কোটি মানুষের হূদয় জয় করেছেন অবলীলায়, তিনি নিশ্চয়ই মরণব্যাধিকেও জয় করে ফিরবেন। হায় রে মরণ! আবালবৃদ্ধ বাঙালির হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হুমায়ূন আহমেদকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঝড়ের মতো! শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম, শুনলাম, চলে গেছেন আমাদের হুমায়ূন ভাই, আর ফিরবেন না তাঁর ভক্ত-স্বজনদের কাছে, প্রিয় ‘নুহাশপল্লী’তে, ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র বাসভবনে। একুশের বইমেলা চত্বরে তীর্থের কাকের মতো ভিড় করা নানা বয়সী অগণিত ভক্তকে অটোগ্রাফ দিতে আর আসবেন না হুমায়ূন আহমেদ।
বাঙালির চিন্তাচেতনায়, মেধা আর মননে তিনি যে কত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তার প্রমাণ দেখছি প্রতিনিয়ত রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা আজ হুমায়ূনময়! ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে সর্বত্র আজ হুমায়ূন ভাইয়ের জন্য প্রাণের আকুতির প্রকাশ, কেন এই বয়সে চলে যেতে হলো তাঁকে!
তরুণ-তরুণীরা রুদ্ধবাক, নগরে-বন্দরে গৃহিণীরা টেলিভিশনের সামনে বসে চোখ মুছছেন; হাটবাজারে, গ্রামগঞ্জে কর্মজীবী, মধ্যবিত্ত মানুষের আক্ষেপ, হুমায়ূন আহমেদের মতো করে আমাদের জন্য আর কে লিখবেন! বন্ধু, স্বজন, সতীর্থরা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছেন লেখক, কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কত জানা-অজানা তথ্য, ছবি আঁকার প্রতি তাঁর আগ্রহ, ম্যাজিশিয়ান হওয়ার শখ, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা, বন্ধুবাৎসল্য, মায়ের জন্য টান—কত কিছু জানতে পারছি আমরা। কিন্তু আসলেই বাংলা সাহিত্যের এই কথা-জাদুকরকে আমরা কতটুকু জেনেছি, জাতি হিসেবে তাঁর জীবদ্দশায় কতখানি মর্যাদা তাঁকে দিতে পেরেছি? একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে শত-সহস্র দেশি-বিদেশি, প্রবাসী বাঙালির সহায়তার অজস্র আশ্বাস তাঁকে আপ্লুত করেছিল, তা-ও সত্যি। প্রধানমন্ত্রীও একবার সময় করে দেখতে গিয়েছিলেন আমেরিকায় চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদকে।
সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা সেদিন তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল, তাঁর দেওয়া আর্থিক সহায়তা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অসম্ভব রকম ব্যয়বহুল চিকিৎসার অর্থ সংকুলান করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন হুমায়ূন ভাই ও তাঁর পরিবার। কিন্তু কখনো আত্মমর্যাদার সঙ্গে আপস করেননি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যখন তাঁকে জাতিসংঘ মিশনে উপদেষ্টার পদ প্রদান করা হয়েছিল, তখন তাঁর ভক্ত-স্বজনেরাই শুধু নন, তিনি নিজেও খুশি হয়েছিলেন। প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল তাঁর পরিবার। হয়তো চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশন থেকে নিয়মিত সহায়তা আসবে, হাসপাতালে যাতায়াত অথবা অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে নিদেনপক্ষে একটি গাড়ি তো পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না! হুমায়ূন ভাই যখন নিউইয়র্কের স্লোন ক্যাটারিং অথবা বেলভিউ হাসপাতালে দীর্ঘ কয়েক মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন প্রতিদিন (বিশেষ করে ফেরার সময় প্রায়ই মধ্যরাতে) বিশাল নিউইয়র্ক নগরের জ্যামাইকার ফ্ল্যাট থেকে স্ত্রী শাওন অথবা স্নেহভাজন মাজহারকে ট্রেনে দীর্ঘ চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে যাতায়াত করতে হয়েছে। হাঁটতে হয়েছে রেলস্টেশন থেকে বেলভিউ হাসপাতালের ছয় ব্লক দীর্ঘ পথ। জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের জন্য আমরা জাতিসংঘ মিশনে একটি পদের ব্যবস্থা করেছিলাম বটে, কিন্তু কোনো সম্মানী ভাতা তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারিনি! তাঁর জন্য, তাঁর চিকিৎসা-সঙ্গীদের জন্য জরুরি প্রয়োজনে কোনো যানবাহনের আয়োজন করতে পারিনি! তবে দেরিতে হলেও জুন মাসের শেষ দিকে যখন হুমায়ূন আহমেদ সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেন তাঁর পরিবারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি বাহনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ধন্যবাদ তাঁকে; শেষ সময়ে হলেও আমাদের কথা-জাদুকরের পরিবারকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের পরিবার তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী গৃহকর্মী মোস্তফাকে তাঁর সেবা-শুশ্রূষার জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিল বেশ আগে। আজও তা প্রক্রিয়াধীন আছে! অদৃশ্য কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমাদের কোনো মন্ত্রণালয়ে অথবা আমেরিকান দূতাবাসে এটি এখনো কেন আটকে আছে, জানি না। শুধু এটুকু জানি, আজ হুমায়ূন আহমেদকে আমরা যে যত শ্রদ্ধাঞ্জলিই নিবেদন করি না কেন, শেষ দিনগুলোতে তাঁর এ ধরনের ছোট ছোট প্রত্যাশাও আমরা পূরণ করতে পারিনি। কিংবদন্তি এই মানুষটি অনেক অভিমানে সেই সময় তাঁর এই সব দিনরাত্রির বয়ান করতে চেয়েছিলেন, সেই লেখার শিরোনামও দিয়েছিলেন: ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’! কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধে সেটি আর প্রকাশ করেননি। (ক্ষমা করো ভাই শাওন, তোমার বিনা অনুমতিতে আজ এগুলো লিখছি। হুমায়ূন ভাইকে যথাসময়ে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি, এ অনুতাপ শুধু আমার নয়, তাঁর কোটি কোটি ভক্ত-স্বজনেরও।)
অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদ জনমানুষের শিক্ষার জন্য যে কত আগ্রহী ছিলেন তার জাজ্বল্যমান নিদর্শন দেখেছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই শিক্ষাবিদ সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে, নিজস্ব অর্থায়নে গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি বিদ্যালয়: ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’; নিজের নামে বা মা-বাবার নামে নয়! এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কী হতে পারে।
এই মহতী আয়োজন, এই বিদ্যাপীঠটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁরই আমন্ত্রণে গত বছর শিক্ষাসচিবসহ আমরা কজন গিয়েছিলাম। জেনেছিলাম, সম্পূর্ণ নিজ খরচে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন তিনি। একপর্যায়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন এই বিদ্যায়তনটি সরকারি সহায়তা পাবে, শিক্ষাসচিব মহোদয়ও কথা দিয়েছিলেন একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আজও তা হয়নি!
হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর প্রায়ই স্কুলটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি, কিন্তু কোনো আশার সংবাদ পাইনি। শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি বারবার যখন জেনেছি নিজের চিকিৎসার ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে যে করেই হোক, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কুতুবপুরে পৌঁছে দেওয়ার কড়া নির্দেশ ছিল তাঁর।
সম্প্রতি তিনি যখন মা ও মাটির টানে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছিলেন, তখন শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের কিছু অব্যবস্থাপনা, কতিপয় শিক্ষকের কোচিং-বাণিজ্য ইত্যাদি তাঁর গোচরে আসে। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ শরীরেও তিনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন; বলেছিলেন, শিক্ষাকে যারা পণ্য বানানোর অপপ্রয়াস চালায়, তাদের তিনি ক্ষমা করবেন না। তাঁর পরিবারের হস্তক্ষেপে সেদিন ওই শিক্ষকেরা রীতিমতো থানা-পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এই জনদরদি পরিচয় আমরা কজন জানি? আশা করছি, শিক্ষাসচিব মহোদয় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠকে সহায়তা করার জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করবেন। হুমায়ূন ভাই আজ চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর এই প্রত্যাশা কি আমরা আজ পূরণ করতে পারি না? শিক্ষামন্ত্রী একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ, তিনি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদকে যথাযথ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আমরা কি পিছপা হব? নিশ্চয়ই না। তবে নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি থাকবে, যাতে আমাদের জননন্দিত, অসাধারণ এই মানুষটির স্মৃতির বাহক শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ যেন বাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসনে পতিত না হয়, স্থানীয় সুযোগসন্ধানী টাউটদের পাল্লায় না পড়ে। এটা স্থানীয় সমাজের দায়িত্ব এবং আমাদের সবারই দায়বদ্ধতা হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন প্রয়াত কালপুরুষের কাছে।
হুমায়ূন ভাই, আপনার বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে বলছি, শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ সগৌরবে এগিয়ে যাবে। আমরা তো আছি, আপনার অগণিত ভক্ত-স্বজন—আমরা আপনার স্মৃতি ধরে রাখব। চিরনিদ্রায় শান্তিতে থাকুন আপনি। সৃষ্টিকর্তা আপনার হেফাজত করুন।
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
0 comments:
Post a Comment