অবৈধ এসব খননের কারণে মুন্সিগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মধ্যে পড়েছে। এসব ভরাটকাজ করতে গিয়ে চক্রগুলোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা, সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটছে। প্রভাবশালী এই চক্রগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার মানিকপুর, পঞ্চাসার, মাঠপাড়া, দেওভোগ, দক্ষিণ ইসলামপুর, পাঁচঘড়িয়াকান্দি, চরকেওয়ার, রনছ মিরকাদিম পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক পক্ষ ভরাটকাজ করে যাচ্ছে। কোনো জায়গায় জমি না দিলে জোর করে ভরাট করা হচ্ছে।
ভরাট করা নিয়ে সংঘর্ষ: সর্বশেষ গত রোববার বিকেলে মুন্সিগঞ্জ শহরের দক্ষিণ ইসলামপুরে একটি নিচু জমি ভরাট করা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হন কমপক্ষে ১০ জন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি রাইফেলের গুলি, দুটি ছোরা ও দুটি চাপাতি উদ্ধার করে। সংঘর্ষের সময় এক বিমা কর্মকর্তার বাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের ভাষ্যমতে, ওই নিচু জমি ভরাট করা নিয়ে যুগনীঘাট এলাকায় সদর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর জাকির হোসেন এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সভাপতি রেজাউল আবেদীন পাশাপাশি দুটি ড্রেজার বসান। সেখান থেকে পাইপ দিয়ে দক্ষিণ ইসলামপুরে ওই নিচু জমি ভরাট করা হবে। জাকিরের সঙ্গে রয়েছেন কোটগাঁও এলাকার শহর বণিক সমিতির সভাপতি আরিফ, কালাম, এনামুল। রেজাউলের সঙ্গে রয়েছেন যুবলীগ নেতা শহীদুজ্জামান, কাজলসহ অনেকে।
যুগনীঘাটের বাসিন্দা ও কলেজছাত্র মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আরেক এলাকার জমি ভরাটের জন্য খননযন্ত্র বসানো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। শুনেছি দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের লোকজন।’
বিমা কর্মকর্তা রাশিদা বেগম বলেন, ‘অফিস থেকে এসে দেখি লোকজন আমার ঘর ঘিরে রেখেছে। কেউ কেউ আমার ঘরে ভাঙচুর করছে ও কোপাচ্ছে। পরে পুলিশ এসে আমার ঘরে আশ্রয় নেওয়া কাউন্সিলর জাকির হোসেনকে উদ্ধার করে।’
এদিকে যে জমি ভরাট নিয়ে এমন ঘটনা সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ধানের জমিতে খননযন্ত্রের পাইপের মুখ। চাষি তোফাজ্জল হোসেন একটি জমি দেখিয়ে বলেন, ‘এই জমি ভরাট করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। অথচ এখানে তিন ফসলি জমি। আলু ও কাউন হওয়ার পর ধান হয়। এই ফসলি জমিই ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। আশপাশে কৃষিজমি ছিল। যেভাবে ভরাট কইরা লাইতাছে আস্তে আস্তে ফসলের জমি থাকব না। দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিব।’
যুবলীগের নেতা পৌর কাউন্সিলর জাকির হোসেন বলেন, নিচু জমি, পুকুর, জলাশয় ভরাট করার ক্ষেত্রে কেউ তো আইন মানছে না। সবাই মানলে আমাদেরও মানা উচিত। আমরাও মানব।’
আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সভাপতি রেজাউল আবেদীন বলেন, ‘আমি ড্রেজার দিয়ে নিচু জমি বা পুকুর ভরাট করছি ঠিক। কিন্তু অন্যদের মতো অন্যের জমি জোরপূর্বক দখল করে ভরাট করি না। আমার নামে এমন বদনাম নাই।’
প্রায় দেড় বছর আগে শহরের মানিকপুর এলাকায় একটি পুকুর ভরাট করা নিয়ে যুবলীগের কাজল ও শহীদ পক্ষের সঙ্গে সেলিম ও এলান পক্ষের প্রকাশ্যে গোলাগুলি হয়।
শহরের নয়াগাঁও এলাকায় ধলেশ্বরী নদে খননযন্ত্রের মাধ্যমে বালু ভরাট করা হচ্ছে। এই যন্ত্রের পাইপ শহর রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে যাওয়ায় এবং বাঁধ ঘেঁষে ড্রেজার বসিয়ে পাইপ দিয়ে বালু তোলার ফলে বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ইরাদত হোসেন বলেন, পৌর এলাকার পুকুর, জলাশয়, খাল, নিচু জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে জেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অনেকবার বলা হলেও জেলা প্রশাসক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
মেয়র বলেন, যুগনীঘাটে একই জমি ভরাট করা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। মুন্সিরহাটে একটি খালের মুখ ভরে ফেলা হয়েছে। নয়াগাঁওয়ে শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। এমন অনেক এলাকা ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এর কোনোটির ক্ষেত্রে পৌরসভার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না ভরাটকারীরা।
ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মেয়র ইরাদত হোসেন বলেন, ‘এরা সরকারি দলের লোকজন। আমি করি অন্য দল। আমি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কী হবে? এটা তো আপনারাই ভালো বোঝেন।’
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বালু ভরাট কার্যক্রম প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আমার পক্ষে কষ্টকর। এ কারণে রাজনীতিসহ অনেক কিছু থেকে দূরে সরে গিয়েছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জের সহকারী পরিচালক সোনিয়া সুলতানার বক্তব্যের জন্য একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসক মো. আজিজুল আলম বলেন, কৃষিজমি, পুকুর, জলাশয়, খাল এবং খাসজমি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভরাট করা হলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভায় আলোচনা সত্ত্বেও ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এবার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।’ প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment