খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে মং সার্কেলের ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ উৎসব। উপমহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরীর হাতে নজরানা ও রাজস্ব তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়েই রাজপুণ্যাহর মূল কর্মসূচির সূচনা হয়। রাজপুণ্যাহকে ঘিরে রাজবাড়ি হয়ে উঠেছে উৎসবমুখর। তবে রাজপুণ্যাহর অনুষ্ঠান থেকে ঐতিহ্যবাহী রাজা, হেডম্যান ও কার্বারী নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে। রাজপুণ্যাহর প্রধান আকর্ষণ রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরী সবাইকে ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থের বাইরে উঠে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল শুক্রবার সকালে গার্ড অব অনারের মাধ্যমে ফুল ছিটিয়ে মং সার্কেল প্রধান রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরীকে মঞ্চে আনার পর তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বরূপ তলোয়ার প্রদান করেন প্রজাদের পক্ষে হেডম্যান কংজরী চৌধুরী। এরপর পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করা হয়। তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে আগামীকাল রবিবার।
রাজপুণ্যাহর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজা সাচিংপ্রু রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে অবৈধভাবে উচ্ছেদ হওয়া মং সার্কেলের উদ্বাস্তু অধিবাসীদের অবিলম্বে নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বহালের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। তিনি বলেন, রাজপুণ্যাহটি রাজ কোষাগার পূরণের চেয়ে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। জনজাতির ঐক্যের সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি অনুযায়ী 'উপজাতি, নৃগোষ্ঠী ও জাতিসত্তা' হিসেবে বর্তমান সরকারই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙালির বাইরেও দেশের অন্যান্য জাতিকে স্ব স্ব ভাষার ভিত্তিতে জাতিসত্তার স্বীকৃতি এর আগে কেউ দেয়নি।
প্রতিমন্ত্রী ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে ভাতা ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
দুপুরে মং সার্কেলের মৌজাপ্রধান হেডম্যান, কার্বারী ও সাধারণ প্রজারাও রাজাকে নত শিরে জুমে উৎপাদিত ফসলের খাজনা প্রদান করেন। রাজস্ব আদায়ের মধ্য দিয়ে রাজপুণ্যাহর মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
এটি অষ্টম রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরীর সময়ে দ্বিতীয় রাজপুণ্যাহ। এ উপলক্ষে খাজনা আদায়ের চেয়ে এটি মূলত পাহাড়ি-বাঙালিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী এই রাজপুণ্যাহকে ঘিরে মং রাজবাড়ীতে লোকজ মেলা এবং ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উৎসব বসেছে।
খাগড়াছড়ির মং সার্কেলের অধীন ৭৫০ জন কার্বারী ও ৮৮ জন হেডম্যান জুমচাষে আহরিত আয়ের উৎস থেকে একর প্রতি এক টাকা হিসেবে রাজস্ব আদায় করে থাকেন।
রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠানে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মামুন অর রশিদ, আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সুধাসিন্ধু খীসা, পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম, ইউএনডিপি পার্বত্যাঞ্চলের প্রধান রবার্ট স্টলম্যান, হেডম্যান কংজরী চৌধুরী, কার্বারী সমিতির সভাপতি রণিক ত্রিপুরা বক্তব্য দেন।
এ সময় হেডম্যান-কার্বারীসহ অন্য বক্তারা পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী হেডম্যান-কার্বারীদের ভাতা বৃদ্ধিসহ শক্তিশালী করার দাবি জানান।
দীঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার কিছু অংশ ব্যতীত খাগড়াছড়ি পুরো জেলার আওতাধীন মং সার্কেলের সপ্তম রাজা পাইহ্লাপ্রু চৌধুরী ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পরবর্তী রাজা হিসেবে অভিষেক ঘটে তাঁরই সন্তান সাচিংপ্রু চৌধুরীর। উল্লেখ্য, ১৮৭০ সালে মং সার্কেল, চাকমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেল নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি পৃথক রাজা প্রথার সূচনা হয়েছিল। kalerkantho
0 comments:
Post a Comment