এই গানের কথাটা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে আমার মনে হচ্ছে। আর আমি ঘুমের মধ্যে বলে উঠছি, এভাবে ভালোবাসা হয় না।
সামপ্রতিক প্রসঙ্গ অবশ্যই টিপাইমুখ বাঁধ। কিন্তু এই কথাটা হয়তো সার্বিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চড়াই-উৎরাই নিয়েই বলা যাবে।
আবার সামপ্রতিক বাংলা গান থেকেই উদাহরণ দিতে হচ্ছে। কৃষ্ণকলির গানের লাইন আছে, দিয়েছি তো যা কিছু দেবার।
বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে আশা করা গিয়েছিল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটা সোনালি যুগে প্রবেশ করল। ভারতের প্রধান উৎকণ্ঠা ছিল তাদের নিরাপত্তা। সন্ত্রাসবাদ, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা—এসব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাহায্য তারা কামনা করেছিল সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যদি তাকে উদারভাবে, আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে, তবে বাংলাদেশের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের হাত নিঃশর্তভাবে তারা এগিয়ে দেবে, এই রকমই একটা ধারণা আমরা পেয়ে আসছিলাম বহুদিন ধরে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে দু পা নয়, কয়েক পা এগিয়ে গেছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা চলছে প্রকাশ্যে। কোনো রকমের ছাড় দেওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশের নেই, তা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বমহলকে। বাংলাদেশের মাটিকে কোনো দেশের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যবহূত হতে দেওয়া হবে না, এই প্রকাশ্য ঘোষণার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সজাগ আর সক্রিয় রয়েছে। ভারতের আরেকটা বড় চাওয়া হলো ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট। ভারতের পূর্ব-অঞ্চলের জন্য মাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের জল-স্থল ব্যবহার করতে দেওয়া। এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছে কি হয়নি, কূটনীতিকেরা, আইনজ্ঞরা তা ভালো বলতে পারবেন, আমরা চর্মচক্ষে যা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে মালামাল পরিবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নদী, নৌবন্দর, সড়কপথ ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ব্যবহূত হচ্ছে (হোক তা পরীক্ষামুলক)। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি হতে পারেনি। তখন আমরা বলেছিলাম, তিস্তার পানি না পেলে ট্রানজিট নয়। যদিও এই তর্ক আছে, অনেকেই বলছেন, অভিন্ন নদীর পানি বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্য, এটা অধিকার; ট্রানজিট অধিকার নয়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে দেওয়া সুবিধা। এর আগেরবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন শুনেছিলাম, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করতে পারবে। এখন সে বিষয়ে আর খুব উচ্চবাচ্য শুনি না।
আমার যদি লাভ না হয়, কিন্তু পড়শির উপকার হয়, নিজের ক্ষতি না করে তা করতে দিতে আমি রাজি। পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি জীবন মন সকলি দাও, তার মতো সুখ আর কোথা আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও। কিন্তু পরের সুখের কারণে নিজেকে কতখানি মূল্য দিতে হবে, তার একটা পরিমাণ জানা থাকা চাই। আমাদের দেশের দুর্বল অবকাঠামোর ওপর দিয়ে ভারতের ট্রাক চলবে, বিপুল ভারবাহী লরির চাপ সইতে না পেরে সেতু আর্তনাদ করে উঠবে, সেতুর নিচে বার্জ আটকে যাবে, কার্বনদূষণ ঘটবে, পরিবেশদূষণ ঘটবে, যানজট হবে, বিনিময়ে কিছুই পাব না?
তবু, তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন। আমরা দিয়ে চলেছি। বিনিময়ে এই কি আমাদের প্রাপ্য ছিল? বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে ফেলল মণিপুর রাজ্য সরকার। অথচ কানে বাজছে মনমোহনের মোহন বাণী—বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছুই করবে না ভারত।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষেই মত আছে, আমরা জানি। পক্ষের মতটা হলো, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখা হবে, ফলে ভাটিতে আর বন্যা হবে না। শুকনো মৌসুমে সেই জল ছেড়ে দেওয়া হবে, ফলে শীতকালে সেচ দেওয়া যাবে। এ থেকে বাংলাদেশও বন্যা ও খরার প্রকোপ থেকে বাঁচতে পারবে। আর এর বিপক্ষের যুক্তিগুলো খুবই শক্ত। এক. এই এলাকাটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। হঠাৎ করে ভূমিকম্প হলে ভাটি অঞ্চল প্রবল বন্যার জলে ভেসে যাবে। অবশ্য সেই ক্ষতি ভারতের ২০০ কিলোমিটার নদীতীরবর্তী অঞ্চলেও হবে। দুই. টিপাইমুখ প্রকল্প কেবল বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, সেচ প্রকল্পও বটে। তাহলে ভারত পানি প্রত্যাহার করবে। ফলে এই নদীর অববাহিকায় এত দিন যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতো, তার ব্যত্যয় ঘটবে।
এমনিতেই, বিদ্যুৎ প্রকল্প হলেও বর্ষাকালে যে উচ্চতায় পানি আসত, তা আসবে না। আবার শীতকালে হয়তো বেশি আসবে। তার মানে হাজার বছর ধরে এই এই অঞ্চল প্রকৃতির যে চক্রে অভ্যস্ত হয়ে আছে, তাতে ছেদ ঘটবে। প্রকৃতির ওপর হাত দেওয়া কোনো দিনই আখেরে সুফল আনে না। এটা অববাহিকা অঞ্চলের মানুষ, কৃষি, মাছ, গাছপালা, লতাপাতা, ভূপ্রকৃতি, নৌপরিবহন, নাব্যতা, জীব বৈচিত্র্য, লবণাক্ততা, না-লবণাক্ততার ওপর কী প্রভাব ফেলবে আমরা তা জানি না। এই জন্যই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প করার আগে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে যৌথ সমীক্ষা হোক। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর যদি দেখা যায়, অপকারের চেয়ে উপকারই বেশি, তাহলে এটা মেনে নিতে আমাদের দিক থেকে কোনো আপত্তির কিছু নেই। আর যদি দেখা যায়, এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, তাহলে মনমোহন সিংয়ের উক্তির বাস্তবায়নই কাম্য: বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছুই ভারত করবে না।
সেই যৌথ সমীক্ষা করা হলো না। টিপাইমুখ নিয়ে কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারতে, প্রকল্প এলাকায়, এমনকি সারা পৃথিবীতে পরিবেশবিদ ও সম্ভাব্য ভুক্তভোগী মানুষ এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদমুখর। সেসব উপেক্ষা করা হলো। একটা চুক্তি করা হলো, যে বিষয়ে বাংলাদেশকে জানানোর কথাও ভাবল না ভারত।
দু পা নয়, অনেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। দিয়ে দিয়েছে, যা কিছু দেওয়ার। কিন্তু ভারত পিছিয়েছে তারও চেয়ে বেশি। এভাবে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা একপক্ষে হয় না। জোর করেও হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। এর মধ্যে শুনতে পেলাম, বাংলাদেশের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর উজানে একটা দেশ একপক্ষীয়ভাবে বাঁধ দিচ্ছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার? বলেন কী ভদ্রলোক!
এই লেখা শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের নাম পেড়ে। শেষ করি তাঁর লেখা মুক্তধারা নাটক দিয়ে। কিছু সংলাপ তুলে দিচ্ছি, বক্তার নামছাড়া।
‘আমার বাঁধ সম্পূর্ণ হয়েছে।’
‘শিবতরাইয়ের প্রজারা এখনো এ খবর জানে না। তারা বিশ্বাসই করতে পারবে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।’
‘দেবতা তাদের কেবল জলই দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে বাঁধবার শক্তি।’
‘তারা নিশ্চিন্ত আছে, জানে না আর সপ্তাহ পরেই তাদের চাষের খেত—’
‘চাষের খেতের কথা কী বলছ?’
‘সেই খেত শুকিয়ে মারাই কি তোমার বাঁধ বাঁধার উদ্দেশ্য ছিল না?’...
এই নাটকের শেষে যুবরাজ সেই বাঁধ ভেঙে দিয়ে তারই জলে ভেসে যায়। এই নাটকের অন্য অনেক মানে আছে, এখন আমাদের কাছে, আমরা যারা সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ে চিন্তিত, তাদের কাছে মুক্তধারা নাটকের মানে এই যে প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দাও, তাকে রুদ্ধ করার চেষ্টা কোরো না। এটা আমাদের চাওয়া, আমাদের বার্তা। কিন্তু ভারত আমাদের কথা শুনবে, এই রকম কোনো লক্ষণ নেই। তাহলে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment