সমাজের বদ্ধমূল এ ধারণা আর বুঝি টিকছে না। ভারতে বিচ্ছেদ বা কোনো কারণে ৫০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে জীবনসঙ্গী হারিয়ে যাঁরা একাকী জীবন পার করছেন, তাঁদের জন্য গতকাল রোববার এক অভিনব মেলার আয়োজন করেছিল একটি বেসরকারি সংস্থা। আহমেদাবাদের মেহেন্দি নওয়াজ জং মিলনায়তনে বসে ছিল এ মেলা। পঞ্চাশ বা পঞ্চাশোর্ধ্বদের জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দেওয়াই ছিল এ মেলার উদ্দেশ্য।
প্রাথমিকভাবে সফলতাও পেয়েছেন আয়োজকেরা। গতকালের মেলায় আসাম, কর্নাটক ও গুজরাট থেকে আসা কমপক্ষে সাতজন তাদের চাহিদা অনুযায়ী জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন। এ জুটিদের অনেকেই তাঁদের দাম্পত্যজীবন শুরু করার আগে কিছু দিনের জন্য ডেটিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
এ সফলতার পর আয়োজকেরা আগামী ছয় মাসে ভূপাল, পুনে, দিল্লি, কলকাতা ও মুম্বাইয়ে এ ধরনের মেলার আয়োজন করতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘বিনা মূল্যে অমূল্য সেবা’-এর প্রতিষ্ঠাতা নাটুভাই প্যাটেল এ মেলা সম্পর্কে বলেন, ‘কেউ কেউ আমাদের এ আয়োজনকে বাড়াবাড়িই বলছেন। কিন্তু আমরা এটাকে একটা নতুন চিন্তা হিসেবেই দেখছি।’
এমনকি নাটুভাই প্যাটেল নিজেও আগামী মাসে একটি বনভোজনে গিয়ে তাঁর জীবনসঙ্গী বেছে নেবেন এবং সেখানে একান্ত সময় কাটাবেন বলে জানিয়েছেন।
গতকালের মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন, এমন এক সৌভাগ্যবান হলেন আহমেদাবাদের ৬২ বছর বয়সী বিপত্নীক জিতেন্দ্র। ৫২ বছর বয়সী অমি পান্ডেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে তিনি রীতিমতো আহ্লাদে আটখানা। জীবনসঙ্গী পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘বিলাসিতার সব কিছুই আমার জীবনে আছে। কিন্তু অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার জন্য আমার কাউকে দরকার এবং আমি তা পেয়েছি।’
অপরদিকে পান্ডে বলেন, ‘আমার এমন একজন দরকার, যাঁর সঙ্গে আমি আমার বাকি জীবন উপভোগ করতে পারি। কেনাকাটা করতে যেতে পারি, সিনেমা দেখতে যেতে পারি।’
এ মেলায় অমি পান্ডের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছর বয়সী মেয়েও হাজির হয়েছিলেন। জিতেন্দ্র-অমি জুটি কিছু দিনের জন্য ডেটিংয়ে যাবেন বলেও ঠিক করেছেন।
মেলায় এসে ৬০ বছর বয়সী চালকলের মালিক নাটু ঠ্যাকারেও তাঁর জীবনসঙ্গী হিসেবে ৫৩ বছর বয়সী জ্যোত্স্না দেবকে খুঁজে পেয়েছেন। জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁর যুক্তি, ‘এ বয়সে যৌনতা বিবেচ্য নয়, আমার দরকার সঙ্গ। আমার এমন একজনকে দরকার, যার সঙ্গে আমি জীবনের বাকি সময় কাটাতে পারি।’
দিল্লি, আসাম, পাঞ্জাব, মধ্য প্রদেশ, তামিল নাড়ু, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে জীবনসঙ্গীর খোঁজে বিচিত্র এ মেলায় দর্শনার্থী এসেছিলেন ৩৫০ জনেরও বেশি। এঁদের মধ্যে ৭০ জনই ছিলেন নারী। আগতদের অধিকাংশই এসেছিলেন গুজরাট থেকে।
আয়োজকেরা বলছেন, তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হলে ভারতের সমাজে বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা দূর হবে।
আয়োজকদের পাশাপাশি মেলায় আগত দর্শনার্থীদের আগ্রহও ছিল লক্ষণীয়। সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে নারীরা রঙিন শাড়ির সঙ্গে নজরকাড়া মেকআপ আর পুরুষেরা মার্জিত পোশাকে মেলায় ভিড় করেছিলেন। ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, কোম্পানির পরিচালক, কৃষক, শিক্ষকসহ প্রায় সব পেশা ও ধর্মের মানুষ এসেছিল এখানে।
মেলায় অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই সহজ। মেলায় নিবন্ধিত প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষ প্রথমেই নম্বর দেওয়া ব্যাজ পরে এবং তাঁর সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে মঞ্চে উঠে তাঁদের সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরেন, আর এ তথ্যের ভিত্তিতে দর্শকের আসনে থাকা বিপরীত লিঙ্গের মানুষটি সম্ভাব্য পছন্দের মানুষের ব্যাজ নম্বর টুকে রাখেন।
পরিচিতি পর্বের পর দর্শকের আসনে থাকা নারীরা তাঁদের পছন্দের মানুষকে ডাকেন। মিনিট পাঁচেক ধরে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করেন। আলাপ শেষে পরস্পরের জীবনসঙ্গী হতে সম্মত হলে তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। এরপর কর্তৃপক্ষ প্রকাশে জুটি ঘোষণা করে।
মেলায় অংশ নেওয়ার জন্য আয়োজকেরা অংশগ্রহণকারীদের জন্য দুটি পূর্বশর্ত রেখেছেন। অংশগ্রহণকারীদের অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং তাঁদের যদি ছেলেমেয়ে থাকে, তবে এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য তাঁদের সম্মতি নিতে হবে।
মেলায় অংশ নিয়ে মোহাম্মদ ইসমাইল শেখ (৫৬) বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর আমি একাকী অনুভব করছিলাম।’ তিনি আরও জানান, তাঁরা ছেলেমেয়েরা তাঁদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত।
৭৮ বছর বয়সী প্রভাত রাওয়াল বলেন, ‘অনেকেই বিষয়টিকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। তাঁরা বলেন, এই বয়সে এ সব কেন ? তবে আমি বলি, কেন নয়? আমার যথেষ্ট অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা রয়েছে এবং আমি আমার জীবনের বাকি সময়টুকু কারও সঙ্গে আনন্দে কাটাতে চাই।’
0 comments:
Post a Comment