গত ১৩ নভেম্বর কল্পনার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়। ফুটফুটে ছেলেটির নাম রাখা হয় বেল্লাল। তবে বেল্লালকে নিজের কাছে রাখতে পারেননি কল্পনা। চরম অর্থাভাবে ছেলেকে ৩৫ হাজার টাকায় ‘বিক্রি’ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ জন্য ১০০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে তাঁর টিপ সই নিয়েছেন ‘ক্রেতা’।
বরিশালের গৌরনদী পৌরসভা সদরে গতকাল মঙ্গলবার ওই ‘চুক্তিপত্র’ সম্পন্ন হয়। চুক্তিপত্রে লেখা হয়েছে, ‘ভরণপোষণের আর্থিক সংগতি না থাকায় ও চিকিৎসার প্রয়োজনে আমি আমার নবজাতক সন্তান বেল্লালকে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে তার কাছে (নজরুল) হস্তান্তর করলাম। এখন থেকে নবজাতক সন্তানের প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। দাবি করলে তা অগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।’
চুক্তিপত্রে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন পাঁচজন। এতে নবজাতককে সরাসরি বিক্রির বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতা এবং সাক্ষীরা বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নবজাতকের বিক্রেতা এবং ক্রেতা ও সাক্ষীদের ভাষ্যমতে, ১০ বছর আগে গৌরনদীর দিয়াশুর গ্রামের প্রয়াত সেকান্দার হাওলাদারের মেয়ে কল্পনা ও পাশের উজিরপুর উপজেলার জল্লা গ্রামের দিনমজুর ঝন্টু হাওলাদারের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়। এরই মধ্যে ঝন্টু আরেকটি বিয়ে করেন।
গত জানুয়ারিতে ঝন্টু তিন সন্তানসহ কল্পনাকে ছেড়ে বরিশাল শহরে হোটেল কর্মচারীর কাজ নেন। সেখানে ঝন্টু আরেকটি (তৃতীয়) বিয়ে করেন।
কল্পনা বেগম প্রথম আলোকে জানান, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামী চলে যাওয়ার পর তিনি আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। ভিক্ষা করে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটান। বেল্লালের জন্মের আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে আশ্রয় দেন গৌরনদী পৌর সদরের দক্ষিণ বিজয়পুর মহল্লার হতদরিদ্র গনি খানের স্ত্রী কালনী বেগম।
কাঁদতে কাঁদতে কল্পনা বলেন, ‘মুই ভিক্ষা কইররা তিনডা পোলামাইয়া লইয়া খাইয়া না খাইয়া বাঁইচ্চা আছি। রোগে সোগে কাতর। পয়সার অভাবে ডাক্তার দেহাইতে পারি না। কী দিয়া অরে (বেল্লাল) বাঁচাইয়া রাখমু। অর খাবার জোগার হরতে পারি না। অভাবের লাইগ্যা মোর বুকের ধন মুই বিক্রি হইররা দিছি। ওরে দেখতে মন চায়। দেখতে পারি না। ছোডো বেলায় মোর বাপ মরার পর মোর মায় মোরে হালাইয়া বিয়া বয়। মোর দাদু মোরে নিয়া ভিক্ষা কইররা বড় হরে। বিয়ার পরে স্বামী হালাইয়া যায়। মোর দুহের পোড়া কপাল। এহন বোহের মানিক বেইচ্চা মোর অসুখ সারতে ডাক্তার দেহাই।’ বলছিলেন কল্পনা।
সন্তান বিক্রির ৩৫ হাজার টাকার দুই হাজার টাকা দিয়ে চিকিৎসা করেছেন কল্পনা। বাকি টাকা রেখেছেন মামা আইয়ুব আলীর কাছে।
কল্পনার স্বামী ঝন্টু হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্ত্রীর খোঁজখবর না নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘মুই কোনো খবর রাহি না, হুনছি কল্পনা অভাবের লাইগ্যা পোলাডা বিক্রি করছে।’
ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম নবজাতক কেনার বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবজাতক ও তার মা কল্পনা অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল। দুটি জীবন বাঁচাতে আমি সন্তানটিকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ওকে (বেল্লাল) আপন সন্তানের মতো আদর দিয়ে মানুষ করব। ওর নতুন নাম রেখেছি নাবিল ইসলাম।’ prothom-alo
0 comments:
Post a Comment