বিটিসিএল সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালের পর থেকে জমতে জমতে এই পরিমাণ বকেয়া দাঁড়িয়েছে। কোনো সরকারের সময়ই চিঠির পর চিঠি দিয়ে, দেনদরবার করেও বিল হালনাগাদ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের সময়ও একই অবস্থা চলছে। ‘জনগুরুত্বপূর্ণ’ বলে এসব দপ্তরের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয় না বলে জানায় বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ। ফলে বছরের পর বছর এভাবেই টেলিফোন বিল বকেয়া পড়ে থাকছে।
বিটিসিএল সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে গত জুন পর্যন্ত হিসাব তুলে ধরে জানানো হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে বিটিসিএলের পাওনা ৪৯ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত যারা টেলিফোন বিল পরিশোধ করেনি, তাদের তালিকা রয়েছে। তবে প্রতিবেদনটিতে কোনো সরকারের আমলের বকেয়া আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বকেয়া আদায় করতে না পেরে ব্যাংকে গচ্ছিত স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভেঙে খরচ করছে বিটিসিএল। অর্থসংকটে পড়ে সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার ১০টি স্থায়ী আমানত ভেঙেছে প্রতিষ্ঠানটি।
শীর্ষ পাঁচ খেলাপি: সরকারের ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের টেলিফোন বিল বকেয়ায় সবার শীর্ষে। এ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিটিসিএলের পাওনা ১০ কোটি ৭৯ লাখ তিন হাজার ৯২৯ টাকা। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টেলিফোন বিল বকেয়া পড়েছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৭ টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাকি চার কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৮০৩ টাকা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চার কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ১৮১ টাকা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে চার কোটি সাত লাখ ৩১ হাজার ৬৬২ টাকা বকেয়া পড়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বক্তব্য: নিজ মন্ত্রণালয়ের বকেয়া টেলিফোন বিলের পরিমাণ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান শিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি খুব সম্ভবত মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মিলিত বিল। কিন্তু এ পরিমাণ বকেয়া থাকার কথা নয়। এ বিল যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রসচিব মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমি সবেমাত্র এ মন্ত্রণালয়ে এসেছি। এখন কিছু বলতে পারব না।’ তাঁর আগের মন্ত্রণালয়ের (পরিকল্পনা) প্রায় ৭০ লাখ টাকা বকেয়া সম্পর্কেও কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য খাতওয়ারি বার্ষিক নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে। তা থেকে টেলিফোন বিল, ভূমি রাজস্ব কর ইত্যাদি পরিশোধ করার কথা।
জানতে চাইলে বিটিসিএলের চেয়ারম্যান এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব সুনীলকান্তি বোস প্রথম আলোকে বলেন, জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বলেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘স্বাভাবিক নিয়মেই’ সব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে প্রতি মাসে বিল ও বকেয়া বিলের পরিমাণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এর বাইরে বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
টেলিফোন বিল বাবদ প্রতি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সরকারি বরাদ্দ কোথায় যায়?—এ প্রশ্ন তুলেছেন টিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট খাতে পাঠানো বরাদ্দ অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ নেই। নিশ্চয় এই অর্থ নিয়ে কোনো ধরনের অদৃশ্য কিছু চলছে।’
অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া আদায়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সাঈদ খান। অগ্রগতির কারণ হিসেবে বারবার তাগাদা দেওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
কোটি টাকার ওপর বকেয়া: কোটি টাকার ওপর টেলিফোন বিল বকেয়া ফেলে রেখেছে সরকারের আট মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো—এলজিআরডি, কৃষি, অর্থ, যোগাযোগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শিক্ষা, ভূমি এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে কৃষিসচিবের অনুপস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, বছর শেষে সাধারণত সব ধরনের বিল পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ বিল হতেই পারে না।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে অতি সম্প্রতি বদলি হওয়া সচিব মোজাম্মেল হকও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিলের পরিমাণ শুনে অবাক হন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের বকেয়া থাকতে পারে, তবে এত টাকা বকেয়া কীভাবে হয়?’
লাখের ওপর বকেয়া: এক লাখ টাকার ওপর টেলিফোন বিল বকেয়া আছে সরকারের এমন দপ্তর, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯টি। এগুলো হলো—রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া এখনো লাখ টাকার ঘর পার হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং পরিসংখ্যান বিভাগ।
বকেয়া টেলিফোন বিল আদায়ে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিল আদায়ের ক্ষেত্রে বিটিসিএল সচেষ্ট আছে। সরকারের কাছে পাওনা বিল অল্পদিনের মধ্যে আদায় করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
কোটির ওপরে বকেয়া
মন্ত্রণালয় টাকা
এলজিআরডি ১,৯৫,৮০,৬৫১
অর্থ ১,৫৫,৮২,৩৮৯
যোগাযোগ ১,৪৮,৯৫,৫৭০
শিক্ষা ১,৩৮,৬১,৮৬৫
ভূমি ১,৩৫,১৪,৬১৮
মৎস্য ও পশুসম্পদ ১,১৭,০৮,৬৬৩
কৃষি ১,০২,৭৯,৮৪৭
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত ১,০০,২৫,২৫৮
লাখের ওপরে বকেয়া
মন্ত্রণালয় ও দপ্তর টাকা
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ৭৭,৫১,২৫২
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৬৯,৪৫,৪০০
পরিকল্পনা ৬৯,২০,৮৫৮
নির্বাচন কমিশন ৫৮,৯২,৫৯৫
পররাষ্ট্র ৫৩,৯৬,৯৯১
তথ্য ৪৭,০৩,২২৩
যুব ও ক্রীড়া ৪০,৭৭,২১৪
সরকারি কর্মকমিশন ৩৮,৭২,৪৫৫
পরিবেশ ও বন ৩৮,৩৬,৮৮৮
শ্রম ও জনশক্তি ৩৫,৩৮,৬৬৩
ডাক ও টেলিযোগাযোগ ৩৪,৬৫,৩৪৭
সমাজকল্যাণ ৩৪,৭০,৩৩৬
শিল্প ৩২,২৭,২৯৯
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও
খনিজ সম্পদ ২৬,৫৪,৫৬১
মহিলা ও শিশু ২৪,৩০,৫৪৬
বাণিজ্য ২৩,৪৬,৮৭৫
পাট ও বস্ত্র ২৩,০৬,১৮৯
সংস্কৃতিবিষয়ক ২০,৫১,৬৬০
বেসামরিক বিমান
চলাচল ও পর্যটন ১৯,২১,৬৩০
নৌপরিবহন ১৪,০৩,৬৫৬
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক ৯,১৮,৬০৯
রাষ্ট্রপতির দপ্তর ৭,৭৭,৮২৯
ধর্ম ৭,৫৬,৫১৮
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক ৬,৭৯,৬৩৫
পানিসম্পদ ৬,৬৫,৫৩৫
বিটিআরসি ৬,৪৬,১৮৬
দুর্নীতি দমন কমিশন ৪,০৪,৬১১
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক ৪,০৫,৭৩৫
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ৩,৯০,৭৭০
প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment