জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কিডনি কেনাবেচার ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে অভাবী পরিবারের এক যুবকের যকৃৎ বিক্রির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
যকৃৎ বিক্রি করে দেওয়া যুবক মেহেদী হাসানের বাড়ি উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে। তাঁর বাবা মাহতাব উদ্দিন তিন বছর আগে মারা গেছেন। যকৃৎ বিক্রির বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় লোকলজ্জায় মেহেদী বর্তমানে উপজেলার বামনগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে গত ৮ মে মেহেদী হাসানের যকৃতের কিছু অংশ কেটে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গিয়াস উদ্দীনের শরীরে লাগানো হয়। জুলফিকার রহমান খানের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক দুজনের শরীরে অস্ত্রোপচার করেন। একাধিক ভারতীয় চিকিৎসকও তাতে অংশ নেন বলে কাগজপত্রে দেখা যায়।
গতকাল রোববার ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, রোগীপক্ষ যে কাগজপত্র হাসপাতালের চিকিৎসকদের দিয়েছে তাতে বলা আছে, গিয়াস উদ্দীন ও মেহেদী সম্পর্কে মামা-ভাগনে। তাতে মেহেদী সম্পর্কে কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (সাবেক) মো. আবদুস সোবহান স্বাক্ষরিত একটি সনদপত্রও আছে।
মেহেদী প্রথম আলোকে বলেছেন, গিয়াস উদ্দীন তাঁর মামা নন। তিনি তাঁকে যকৃৎ (তাঁর ভাষায় কলিজা) দান করেননি। তিনি তিন লাখ টাকায় যকৃতের অংশ বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু পুরো টাকাও তাঁকে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে আবদুস সোবহান বলেছেন, মেহেদীর নামে তিনি কোনো সনদপত্র দেননি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, রোগীপক্ষ থেকে আত্মীয়তার কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতারণা কিছু হয়ে থাকলে তার দায়দায়িত্ব রোগীপক্ষের। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বিশেষ কিছু করার নেই।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে (১৯৯৯) বলা আছে, নিকটাত্মীয় (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও রক্ত-সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী) দেহে সংযোজনের জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যবসার জন্য আত্মীয় সাজানো হচ্ছে।
সরেজমিন দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেহেদীর ভূমিহীন বাবা মাহতাব উদ্দিন দর্জির কাজ করে সংসার চালাতেন। অন্যের জায়গায় কুঁড়েঘর তুলে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করতেন। মেহেদীর চাচাতো ভাই এনামুল হক জানান, মেহেদী নম্র ও ভদ্র স্বভাবের ছেলে। বিনইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও অর্থাভাবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি তিনি।
মেহেদী হাসানের বয়স ১৯ বা ২০। হাসপাতালের কাগজে লেখা আছে ২৩ বছর। প্রথম আলোকে মেহেদী বলেন, বাবার সেলাই মেশিনের উপার্জন দিয়ে তাঁদের সংসার চলত না। ছোট ছোট ভাইবোনকে নিয়ে মাঝেমধ্যে না খেয়ে থাকতে হতো। অভাবের কারণে বাবাকে ছেড়ে যান তাঁর মা। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইবোনের দায়িত্ব তাঁর ওপর পড়ে। শ্বশুরবাড়ি থেকে সহযোগিতা পাওয়ার আশায় বাকপ্রতিবন্ধী এক মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। তাতেও সমস্যা মেটে না।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘লোকমুখে শুনি, এলাকার অনেকেই কিডনি বিক্রি করছে। মোটা অঙ্কের নগদ টাকাও মিলছে। ছোট ভাইবোনদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার জন্য নিজের একটি কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। অনেক দালালই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে।’
মেহেদী বলেন, আবদুস সাত্তার, গোলাম মোস্তফা, আতিকুর রহমান, রাসেল, সাইফুল—এঁরা কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত, দালাল। এঁদের সঙ্গে কয়েকবার ঢাকায় যান তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুবিধা না হওয়ায় (টিস্যু টাইপিংয়ে মিল না হওয়ায়) কয়েকবার ঢাকা থেকে ফেরত পাঠানো হয় মেহেদীকে। তবে সাইফুল মুঠোফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস সাতেক আগে ঢাকার মুঠোফোনে সাইফুল বলে—তুমি যদি লিভার (যকৃৎ) বিক্রি করতে চাও, তবে ভালো দাম পাবা।’ সাইফুল আশ্বস্ত করেন, যকৃতের কিছু অংশ কেটে নিলে অস্ত্রোপচারের কিছুদিন পর আবার তা পূরণ হয়ে যায়। যকৃৎ দেওয়ার বিনিময়ে সাইফুল তাঁকে তিন লাখ টাকা দেবেন বলেও মৌখিক চুক্তি করেন। এরপর এ বছর ২ মে ঢাকায় আসেন মেহেদী। গিয়াস উদ্দীনের বাসায়ও যান তিনি।
৬ মে যকৃৎ প্রতিস্থাপনের জন্য মেহেদীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, ‘সেখানকার চিকিৎসকেরাও আমাকে জানান, যকৃৎ দিলে সমস্যা হবে না। কেটে নেওয়া অংশ আবার পূরণ হবে। মীর গিয়াস উদ্দীন নামে একজনকে মামা পরিচয় দিয়ে এভিডেভিটে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ৮ মে অস্ত্রোপচার করা হয়। ২২ মে হাসপাতাল থেকে আমাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।’
মেহেদীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই ক্রেতার কাছ থেকে চুক্তির টাকা নিয়ে লাপাত্তা হন সাইফুল। এতে মেহেদী ভেঙে পড়েন। পরে ক্রেতাপক্ষ তাঁর নামে সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়।
মেহেদীর শরীরে যকৃৎ কেটে নেওয়ার দীর্ঘ দাগ। বর্তমান শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মেহেদী বলেন, ‘আমি আসলে জীবন্ত লাশ হয়ে গেছি। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। কিছুই খেতে পারি না। ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। পায়খানা করতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। সামান্য খেলেই পায়খানায় যেতে হয়।’ বললেন, কোনো কাজ করতে পারেন না। পরিবার একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে।
মেহেদীর অভিযোগ, গিয়াস উদ্দীন (শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির সাবেক সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি) খোঁজ নেন না। ফোন করলে পরিবার থেকে বলা হয়, ‘উনি মারা গেছেন।’
গতকাল সন্ধ্যায় গিয়াস উদ্দীনের পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে কান্নায় ভেঙে পড়েন এক নারী। নিজেকে গিয়াস উদ্দীনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন তিনি। তিনি আর কিছু বলতে চাননি। রাতে হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, গিয়াস উদ্দীন মারা গেছে।
0 comments:
Post a Comment