এ কথা যেমন সত্যি যে, টেনশন মানুষের জীবনে স্বচ্ছন্দ গতি এবং স্বাভাবিক গতিতে চলার পথে বিঘ্ন ঘটায়, তেমনি এ কথাও অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে, জীবনে কিছু পরিমাণ টেনশন থাকা প্রয়োজন। কেননা এই টেনশন জীবনের কাজ করার পেছনে উৎসাহ জোগায় অর্থাৎ কাজ করার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এক কথায় জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার পেছনে প্রেরণা জোগায়। এ ধরনের স্বাস্থ্যকর টেনশন নিয়ে অবশ্য চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ভাবতে হবে সেসব টেনশন নিয়ে যাকে অস্বাস্থ্যকর টেনশন বলা হয়, ওই সব টেনশন যা মনের শান্তি নষ্ট করে, ক্ষুধামান্দ্যর জন্ম দেয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক অসুন্দর করে। জীবনের হাসি-আহ্লাদকে বর্জন করে। অর্থাৎ পুরো জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তোলে।
একজন ব্যক্তির মাঝে টেনশন সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কারণ নানাবিধ যেমন-তার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, মানসিক ও পরিবেশগত কারণ নিহিত থাকতে পারে। বলা বাহুল্য, শুধু একটি কারণ নয় বরং কয়েকটি কারণ সমিমলিতভাবে একজনকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল, সমস্যাজর্জরিত দরিদ্র দেশ। দেশের সিংহভাগ মানুষ আর্থিক টানাপড়েনের দরুন জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেও অক্ষম। আর্থিক অভাব-অনটন, পরিবারে নানাবিধ কলহ-বিবাহ, ঝগড়া ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে। ফলে কীভাবে এ পরিস্থিতির অবসান ঘটতে পারে বা কীভাবে এর সমাধান সম্ভব এসব চিন্তা-ভাবনা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বা উপার্জনক্ষম যুবকের মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে, যা তাদের স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
আর্থিক অভাব-অনটন ছাড়া যে কোনো কারণ যেমন স্বামী-স্ত্রীর ভেতর মনোমালিন্য, সন্তান-সন্ততির অবাধ্যতা, পরিবারের আপনজনের দুরারোগ্য ব্যাধি ইত্যাদি কারণে জের হিসেবে কেউ কেউ ভীষণ উৎকণ্ঠিত ও আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে পারে, যার পরিণতিতে তারা টেনশনের মতো মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে পারে।
দ্রুত সমাজ পরিবর্তন ও নগরায়নের ফলে মানুষের জীবনে নানা সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এসব জটিলতা ও সমস্যার মোকাবিলা ও সামাল দিতে গিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত রাগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্থিরতা এ ধরনের অনভিপ্রেত অনুভূতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হতে হচ্ছে। এর পরিণতিতে তারা টেনশনের শিকার হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নগরকেন্দ্রিক জীবনে এর ব্যাপকতা ও প্রকোপ বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়।
যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই অনেক সময় মানুষের মাঝে টেনশন হতে পারে। যে কোনো ব্যাপারে অহেতুক ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা কল্পনা করে অনেকে অযথা টেনশন করতে থাকে। সাধারণত যেসব ব্যক্তি কল্পনাপ্রবণ, অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল তারা যে কোনো ঘটনায় বিচলিত ও মুষড়ে পড়ে এবং কোনো ঘটনার পরবর্তী বিপদের কথা আগাম চিন্তা করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
পরিবেশগত প্রতিকূলতাও অনেক সময় কারো কারো মনে টেনশন তৈরি করতে পারে যেমন- কেউ কোনো জরুরি কাজে রাস্তায় বের হলেন। সঠিক সময়ে তাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। পথিমধ্যে শুরু হলো ট্র্যাফিক জ্যাম। এ ক্ষেত্রে তার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সঙ্গত কারণেই নিজের অজান্তেই তার মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয়ে টেনশন হতে পারে যে, তিনি নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হবেন কি না? এর ওপর গাড়ির ধোঁয়া, বায়ু দূষণ, চড়া শব্দ ইত্যাদির মতো পরিবেশগত প্রতিকূলতা একে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এমন দেশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কারো কোনো টেনশন নেই। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে টেনশন থেকে পরিত্রাণের কি কোনো পন্থা আছে? এ ক্ষেত্রে বলা যায়, টেনশন সৃষ্টির কারণগুলো দূর করা গেলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আসলে টেনশন কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাধি নয়। এটি হলো একটি সামগ্রিক মানসিক অবস্থা। জীবনের সমস্যাসঙ্কুল চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে এক টেনশন থেকে আর এক টেনশনের সৃষ্টি হয়। এখন এ টেনশন উপশমের জন্য যেসব বিষয় সহায়তা করে থাকে তা নিচে আলোচনা করা হলো।
আজকাল মানুষ বিভিন্ন কাজ ও পেশায় ব্যস্ত। যার ফলে তাদের সময়ের চাকার সঙ্গে তাল মেলাতে বেশ কষ্ট ও অসুবিধা হয়। তাই সময়কে নির্দিষ্ট কাজের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাগ করে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করলে টেনশন অনেকাংশে লাঘব হয়ে যাবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সময়কে ভাগ করে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্পর্কিত উৎকণ্ঠা অনেক সময়ে মানুষের মধ্যে টেনশনের উদ্রেক করতে পারে। কাজেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যক্তি তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারে এবং স্বাস্থ্যগত নিশ্চয়তা টেনশন কমানোর ব্যাপারে সহায়ক হবে।
যে কোনো ঘটনা বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে এ আশঙ্কায় অনেকে অযথা উৎকণ্ঠিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে এ কথা মনে রাখতে হবে জীবন মানে কিছু সমস্যা থাকবে এবং এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে যা জীবনে কাম্য নয়। তবে এও ঠিক, সবকিছুর সমাধান রয়েছে ও সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়। কাজেই বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। ফলে কিছুটা টেনশন কমে যাবে।
মানুষ ব্যক্তিগত কিছু কথা তার বিশ্বাসভাজন ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করে হালকা হতে বা প্রয়োজনবোধে তার সৎ পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তার কাজের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা ও যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে। ফলে তার দুশ্চিন্তার নিরসন হতে পারে।
নিয়মমতো কাজ সম্পাদন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কেননা অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ ও অগোছালো কাজ কখনো সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না এবং এর থেকেই উৎপত্তি হয় এ টেনশনের। কাজেই নার্ভাস না হয়ে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে আর টেনশন থাকে না।
কথায় বলে অলস মস্তিষক শয়তানের কারখানা। অর্থাৎ কাজবিহীন অলসভাবে সময় কাটানো নানা ভাবনা-চিন্তা মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাই বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হলে বাগান পরিচর্যা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে সময় কাটানো কিংবা হালকা ও আনন্দদায়ক পত্রিকা এবং ধর্মসংক্রান্ত বই পড়ে নিজেই ব্যস্ত থাকলে মানসিক অবস্থা প্রফুল্ল ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে।
যে কোনো কাজ শুরুর আগে আপনার সেই বিষয়ে কতটুকু ক্ষমতা আছে সে সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। অর্পিত দায়িত্ব আপনি সামলাতে পারবেন কি না তা ভেবে নিন। অনেক সময় আমরা না ভেবে যে কোনো কাজের দায়িত্ব নিই। পরে কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যাই। আর তখনই শুরু হয় টেনশন। কাজটি ঠিক সময়ে শেষ হবে কি না এ ধরনের শঙ্কা এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তাই কাজ শুরুর আগে কাজের ধরন ও আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে ভাবা দরকার।
টেনশনে আক্রান্ত হলে আপনার জীবনধারায় পরিবর্তন আনুন। পোশাক-আশাক, লাইফ স্টাইলে বৈচিত্র্য আনুন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠুন। কোনো ছবি থাকলে টেনশনের সময় তাতে মনোযোগ দিন। ছবিটা যেহেতু একান্ত নিজের, তাই এতে আপনি নিজের ভালো লাগার এবং আপন জিনিসের মধ্যে ডুবে থেকে টেনশন থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
শুধু না বলতে না পারার কারণেই বহু অপরাধ, অন্যায়-আবদার, আদেশ থাকে যা মনে না চাইলেও গ্রহণ করতে বাধ্য হই। শুরু হয় টেনশন। তাই এ ধরনের কাজ থেকে রেহাই পেতে হলে না বলার চেষ্টা করুন। যুক্তি দিয়ে আপনার অপারগতা প্রকাশ করুন।
আপনার দৈনন্দিন কাজ-কর্মগুলো একটি নির্দিষ্ট ছকে ফেলুন, যাতে সেগুলো সহজে সম্পন্ন করা যায়। দৈনন্দিন কাজের পরিকল্পনার অভাবে প্রায়ই টেনশন তৈরি করে। কাজেই দৈনন্দিন কাজকর্মগুলোর একটি পরিকল্পনা তৈরি করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
লিখে রাখা এক চমৎকার অভ্যাস যা টেনশন তৈরি হতে দেয় না। অনেক জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা কথা, মনে না থাকায়ও অনেক সময় টেনশন হতে পারে। তাই সবকিছু চট করে লিখে রাখলে কোনো কাজের ভুল হয়ে গেলেও বিব্রত হতে হয় না, সৃষ্টি হয় না টেনশনেরও।
টেনশন যাতে না হয় তার জন্য প্রয়োজন প্রতিদিন কিছু ব্যায়ামের। কিছু খেলাধুলা বা সাঁতার এ ক্ষেত্রে খুব উপকারী হতে পারে। সে সঙ্গে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে স্থিরভাবে বসা, মনকে সংহত করে আনার জন মেডিটেশন বা ধ্যানকে যদি অভ্যাস করা হয়, তবে অকারণে টেনশন হবে না কখনোই।
কল্পনা নয় পরিকল্পনা তৈরি করুন
চারদিকে এখন যান্ত্রিকতার সরব। হই-হুল্লোড়, শব্দ দূষণ আর কোলাহল সব ধরনের দূষণের মধ্যে শান্ত পরিবেশ পাওয়া দুষকর। এজন্য যদি সম্ভব হয় তাহলে নিচু লেভেলে প্রিয় কোনো গান বা বাজনা শুনুন। দেখবেন প্রতিকূল আওয়াজের কবল থেকে মুক্ত থাকবেন। শান্ত পরিবেশ ও হাল্কা গান বা বাজনা আপনাকে অনেকটাই টেনশনমুক্ত রাখবে।
জীবন মানে শুধু কাজের ঘানি টানা নয়। ছকে বাঁধা জীবন গড়তে শখ অপরিহার্য। তাছাড়া টেনশন দূর করতে শখের বিকল্প নেই। নিজের ভালো লাগা, ভালোবাসার শখের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন। দেখবেন জীবন থেকে টেনশন একদম চলে গেছে।
সূত্র : মনোজগত
0 comments:
Post a Comment