বহির্বিশ্বে আমাদের দেশ ‘হুজ্জতে বাঙ্গাল’ নামে খ্যাত। সচরাচর ‘হুজ্জতে’ শব্দটির অনুবাদ করা হয় কলহপ্রিয়। আত্মমর্যাদার খাতিরে আমি তার অনুবাদ করলাম অজুহাতপ্রিয়। আমাদের অজুহাত প্রদান অনেক সময় বাইরের মানুষকে আশ্চর্য করে। ১৯৪০-এর দশকে মুসলমান হিসেবে আমরা দাবি তুললাম আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আর পাকিস্তানও অর্জন করে ফেললাম। তারপর বাঙালি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি তুললাম আর বাংলাদেশও অর্জন করলাম। কোনো দেশ একাধিকবার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি তুলতে পারে কি না কিংবা ভারতের সমর্থন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনটা হস্তক্ষেপ ছিল কি না, সেসব প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের কাছে একেকটা জটিল ধাঁধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান—দেশের জনগণের যৌথ প্রকল্প বিংশ শতাব্দীর এক মহাদর্শনীয় ঘটনা।
কয়েক দশক আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের একাংশ আপত্তি এবং/ অথবা সংশয় পোষণ করত। আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে ইসলামি পরিচয়ের প্রতি রাজ্যাতিরিক্ত আনুগত্য থাকতে পারে। আর আরবি ও উর্দুকে অনেক সময় মনে করা হতো ইসলামি ভাষা।
সেই সময় বাংলা সাহিত্য পৌত্তলিক চিত্রকল্প এবং দুর্বলচিত্ত লেখকদের মুসলমানবিরোধী সহিংস লেখালেখিতে পরিপূর্ণ ছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের বদলে এরা মুসলমানদের লক্ষ্য করে বাক্যবাণ ছুড়েছে। এমনকি, ‘শিবাজি উৎসব’ লেখার জন্য রবীন্দ্রনাথকেও সমালোচিত হতে হয়েছে। মুসলমানরা এর বাণী উপেক্ষা করতে পারেনি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এই রচনাটি উপেক্ষা করেন এবং তাঁর রচনাসমগ্রে এ কবিতাটি তিনি অন্তর্ভুক্ত করেননি। জসীমউদ্দীনের মতো মুসলমান কবিরা ‘বন্দে মাতরম’ গানের অন্তর্ভুক্তি পছন্দ করেননি। গানটি রচিত হয়েছিল অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক পটভূমিতে। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক পরিমার্জিত এ গান অন্যতম জাতীয় সংগীত হিসেবে মুসলমানরা ভালোভাবে নেয়নি।
গত শতকের প্রথম দশকে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ মুসলমানদের অবস্থার উন্নতিকল্পে রবীন্দ্রনাথ ইতিবাচক পদক্ষেপের পক্ষে কথা বলেন। কয়েক দশক পর অনেকের সঙ্গে সমস্বরে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের বেশি সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ আপত্তি জানান।
রবীন্দ্রনাথ অভিজাততন্ত্রী; তিনি কখনো গণতন্ত্রী ছিলেন না। সমাজে সম্পদ, শিক্ষা ও মানমর্যাদা অনুযায়ী হিন্দুদের জন্য তিনি অধিকতর প্রতিনিধিত্ব চেয়েছিলেন। বাঙালি মুসলমানদের পত্রিকা মুসলমান মন্তব্য করেছিল, ‘গণতন্ত্রের এই যুগে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিরোধী ভিতের ওপর কতগুলো দাবি উত্থাপিত হতে দেখে আমরা বিস্মিত। ড. রবীন্দ্রনাথ যেসব ধারণা প্রচার করেছেন, সেসবের সঙ্গে এ দাবিগুলো কতটা সংগতিপূর্ণ, আমরা তা বলতে পারছি না।’
রক্ষণশীল মুসলমানদের একাংশের অভিমত ছিল, পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজন হলে রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দিতে হবে। তরুণেরা জানত, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া বাংলা ভাষার চর্চা করা যায় না। তাই প্রয়োজন হলে পাকিস্তানকে বিসর্জন দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করতে হবে।
রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করা নিয়ে বাংলাদেশে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ৫ জুলাই সাবেক এক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক (যিনি এককালে অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলার পক্ষে কথা বলেছিলেন) ও তৎকালীন ইসলামিক একাডেমির পরিচালক আবুল হাশিম বলেন, ‘যাহারা ইসলাম ও পাকিস্তানী আদর্শের নামে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের ওকালতী করিতেছেন, তাঁহারা শুধু মূর্খই নহেন, দুষ্টুবুদ্ধি-প্রণোদিত ও তাঁহারা না বোঝেন রবীন্দ্রনাথ, না বোঝেন ইসলাম।’
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় ঘোষণা দেন, ‘আমরা এই ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হইবেই।’ সে বছর ১৬ ডিসেম্বর রবীন্দ্রসংগীতের কিছু রেকর্ড উপহার পেয়ে তিনি বলেন, ‘... ভেস্টেড কোয়ার্টারস উইল অলওয়েজ বি অ্যাকটিভ টু ব্রিং কালচারাল সাবজুগেশন টু পারপেচুয়েট এক্সপ্লয়টেশন অব দ্য পিপল। বাট দ্য পিপল মাস্ট স্ট্যান্ড ইউনাইটেড টু কারেজাসলি ডিফেন্ড দেয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ আন্ডার সারকাম্সেটনসেস।’ দুই বছর পর এ তারিখেই স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ প্রথম বিজয় দিবস উদ্যাপন করে।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার দিনে এক সাংবাদিক মুজিবকে প্রশ্ন করেন, ‘জাতির প্রতি আপনার বাণী কী?’ জবাবে শেখ মুজিব তখনই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
রবীন্দ্রনাথের মতো মহান কবির সমসাময়িকতা দেখানোর ভার সেই অন্ধ লোকটির চেয়েও বড় সমস্যা, যাকে একটি হাতির বর্ণনা দিতে বলা হয়েছিল। গ্রাম, গ্রামীণ উন্নয়ন, আত্মশক্তি জোরদার করতে শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মতো বিষয়গুলোতে রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন আগ্রহ আমাদের কিছু ধারণা দিতে পারে।
আগামী দুই দশকে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশ। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বিপুল পরিমাণে বাড়বে। গ্রামে ফিরতে হলে গ্রামবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখার দিকে আবার নজর ফেরাতে হবে। ব্যক্তির নিজস্ব শক্তি ও সুপ্ত সামর্থ্য উপলব্ধির জন্য শিক্ষাকে হূদয়ে প্রোথিত করতে তাঁর পরামর্শের কাছে ফিরে যেতে হবে। ‘আত্মশক্তি’ প্রবন্ধে ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভারতে কোনো একটি গ্রাম যদি সক্ষমতা দ্বারা নিজেকে জয় করতে পারে, তখনই স্বেচ্ছায় নিজের দেশ অর্জনের যাত্রা শুরু হতে পারে। আমরা কি পেরেছি সেই লক্ষ্য পূরণ করতে—ওয়ার্ধা, শান্তিনিকেতন বা কুমিল্লায়? রবীন্দ্রনাথের ধারণা শুধু ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়; বিচ্ছিন্নভাবে কোনো গ্রাম উন্নত হতে পারে কি না, তা নিয়ে অধিকতর বিচার-বিবেচনারও দাবি করে। ওপর থেকে চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নতত্ত্ব কেবলই এক সাধু আকাঙ্ক্ষা বলেই প্রতীয়মান হয়।
বিদেশি শাসকদের প্রতি জনগণের ঘৃণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে অবদান রাখবে—এমন ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৮ সালে রচিত ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ঘৃণার কারণ অথবা বস্তু দূর হলে এবং ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে দেশে ফিরে গেলে ভারতবাসীর ঐক্যের কৃত্রিম সূত্রটি ছিঁড়ে যাবে—আমাদের তখন নতুন করে ঘৃণার বস্তু দরকার পড়বে। তখন তার খোঁজে হয়তো আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমাদের ভেতরকার রক্তপিপাসু বিদ্বেষ আমাদেরই ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ করে ফেলবে। ভারতের পাঞ্জাব, বঙ্গ ও বিহারের দাঙ্গায় রবীন্দ্রনাথের সেই প্রাজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী আমরা ফলতে দেখেছি।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের বৃহত্তর পরিসরে ঠাঁই করে নিতে চেয়েছিলেন, যেন সারা পৃথিবীতে তিনি স্বদেশবাসীর দেখা পান। রবীন্দ্রনাথ, আজ আপনি চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। আপনার ওপর আলোচনা করতে এবং আপনি আমাদের কতটা সমসাময়িক তা বিচার করতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আপনার স্বদেশবাসী আজ এখানে সমবেত হয়েছে।
তুকারাম, কবীর ও লালনের মতো সুফি কবিদের চলমান ধারায় রবীন্দ্রনাথের অবস্থান। কিন্তু এই মরমি কবির বিচরণ কেবল আত্মমুক্তি এবং উপনিষদের ও এই পার্থিব জগতের অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করতে চাওয়ার মধ্যেই নয়। তিনি সেই ঋষি, যিনি ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বিশ্বপরিচয় রচনা করেন, বৈজ্ঞানিক ধারণা ও মূল্যবোধ হূদয়ে গেঁথে নেন, সুতা কাটার চরকা অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হতে পারে কি না—তা নিয়ে বিতর্কে নামেন, কৃষিতে ট্রাক্টর যন্ত্র নিয়ে আসেন, চাষিদের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সচেষ্ট হন ও বিরোধ মীমাংসার বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দেবতা, উপনিষদ, অসীম ও সীমার ধারণা সহজে বোধগম্য নয়। এসবের কিছু কিছু ভাসা ভাসা। সাধনায় ব্রহ্মার উপলব্ধির কথা শোনার পর ১৯১৩ সালের জুন মাসে বারট্রান্ড রাসেল লন্ডন থেকে লেখা এক পত্রে অটোলিন মোরেলকে লেখেন, ‘নদী গিয়ে মহাসমুদ্রে মিলিত হওয়া আর ব্রহ্মের সঙ্গে মানুষের মিলন নিয়ে এটা পুরাদস্তুর জঞ্জাল, মামুলি রচনা...মানুষটা নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক, কিন্তু বাতিল কথা নিয়ে বকবক করছেন।’ ১৯৬৭ সালে অসীমের ধারণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে তিনি অর্থহীন, অস্পষ্ট বলে অভিহিত করেন। রবীন্দ্রনাথের যে ভাষা অসংখ্য ভারতীয় পছন্দ করে, সে সম্পর্কে রাসেলের মন্তব্য, ‘দুর্ভাগ্যবশত তা আসলে কোনো অর্থ বহন করে না।’
আইনস্টাইন রসিকতা করে রবীন্দ্রনাথকে ‘র্যাবাই’ (ইহুদি পুরোহিত) বলতেন। জর্জ বার্নার্ড শ একটি নাটকে মঞ্চের বাইরের এক চরিত্রের নাম দিয়েছিলেন কবি ‘স্টুপেন্দ্রনাথ বেগর’। আবার ১৯৪১ সালে কবি মারা যাওয়ার পর বার্নার্ড শ-ই ন্যাশনাল গ্যালারির তৎকালীন পরিচালককে রবীন্দ্রনাথের ছবি টাঙাতে বলেন। ১৯৮৪ সালে টি এস এলিয়টের জীবনীকার পিটার অ্যাক্রয়েড তাঁকে নোবেল বিজয়ী ছয় ব্রিটনের অন্যতম বলে গণ্য করেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেক কিছুই এখন অচল। সেটাই ঘটার কথা। চেহারা-ছবি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও যন্ত্রপাতির এন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। ববকাট চুল থেকে কবরী খসে পড়বে, এমনটা আশা করা যায় না। কল ঘুরিয়ে জল পাওয়া গেলে বেলা হলো বলে সখিকে নদী থেকে জল আনতে তাড়া দেওয়ার কথা ওঠে না। আইনও বদলাচ্ছে। ভারতে হিন্দুরা সাত পাকের বিয়ে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। বিধবা বিয়ের প্রশ্নে এখন আর কেউ চোখ কপালে তোলে না।
তবে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য লেখায় এটা প্রতীয়মান হয়, যেন তিনি সেসব আমাদের জন্যই লিখেছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কোনো ছাপ নেই এগুলোর গায়ে। শিক্ষা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, পরিবেশ, বৃক্ষরোপণ ও পানীয় জল সরবরাহ, মানব-উন্নয়ন, আত্মশক্তির উন্নয়ন বা গরিবি হটানোর প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমসাময়িক; আরও বহু দিন পর্যন্ত আমাদের সমসাময়িক থাকবেন। বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতির অনেকটাই তাঁর প্রেরণাসঞ্চারী প্রবন্ধগুলোর অবদান। তাঁর রচনাবলি আমাদের জন্য বদ্ধ নয়। আমরা মাঝেমধ্যেই পড়ি। আমাদের গীত ও নৃত্যে আছে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁকে ঘিরে এবং তাঁর লেখা নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই। তাঁর শব্দরাজি আমাদের সুভাষিত উক্তি।
উন্নয়নের পরিকল্পনা করার সময় রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি আমরা মনে করতে পারি, ‘সমস্ত শরীরকে প্রতারণা করিয়া কেবল মুখেই যদি রক্ত সঞ্চার হয়, তবে তাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না।’ একইভাবে উন্নতির কথা বলতে গিয়ে গোটা দেশকে উপেক্ষা করলে তাকে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বলা যায় না। তিনি মনে করতেন, ‘সুবিস্তীর্ণ আরম্ভের অপেক্ষা করা, সুবিপুল আয়োজন ও সমারোহের প্রত্যাশা করা কেবল কর্তব্যকে ফাঁকি দেওয়া।’ ক্ষুদ্রই সুন্দর, রবীন্দ্রনাথ এই ধারণার প্রথম দিককার প্রবক্তার অন্যতম।
স্বাধীনতার মূল্য অতন্দ্র প্রহরা। রবীন্দ্রনাথ একই কথা বলেন ১৯৩৭ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল লিভার্টিজ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক শুভেচ্ছাবার্তায়, ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা এমন এক বিশেষাধিকার, যা একজন ব্যক্তিকে প্রতিদিন রক্ষা করতে হবে, কারণ প্রজার অনীহা বা কাপুরুষতার জন্য সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জুলুমবাজিও প্রলুব্ধ হতে পারে নিপীড়নপ্রবণ হতে।’
মাতৃভাষার প্রশস্তি করে সম্পূর্ণ কোনো কবিতা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। তবে মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে চিন্তাদীপ্ত কিছু নিবন্ধ লিখেছেন। বাঙালি জাত্যাভিমানে বিপথগামী হয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবেশী রাজ্য ওডিশা ও আসামের ভাষাকে বাংলারই সম্প্রসারণ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তবে অনতিকাল পরই তিনি নিজেকে শুধরে নেন। তাঁর এক সম্পর্কীয় জামাতা, অহমিয়া ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বলেন, ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের ভাষা যখন পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হবে, তখন পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ঐক্যের সেতুবন্ধ সংহত হবে।
কিছুদিন আগ পর্যন্তও বিদেশি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে ইমারশন (নিমজ্জন) পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথের মত ছিল এর ব্যতিক্রম। তাঁর মতে, আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তার ওপর গড়ে উঠবে অন্য ভাষার সৌধ। এ ধারণার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমকালীন সহযাত্রী। কয়েক মুহূর্ত আগে বাঙালি জাত্যাভিমান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা বলেছি। সেটা তো পুরোপুরি ভুল-ভারাক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ কোনো দিন উগ্রপন্থী ছিলেন না। চেষ্টা করেছেন অন্য পক্ষের অভিমত বুঝতে। সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত ভালোভাবে জানার ফলে তিনি হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি।
একদা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যদি এমন কোন ভালো থাকে যা একমাত্র ভারতবর্ষেরই ভালো তবে তা ভালোই নয়, এ কথা জোর করিয়া বলিব। যদি ভারতের দেবতা ভারতেরই হন তবে তিনি আমাদের স্বর্গের পথ বন্ধ করিবেন, কারণ স্বর্গ বিশ্বদেবতার।’
‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি বলতে চেয়েছেন, মানুষ তার কাজ সমাধা করলে সংসার তা গ্রহণ করে; ধ্বংস করে ফেলে না। কিন্তু মানুষ যখন নিজের জন্য স্থান চায়, তখন সে হয়তো নৌকায় ঠাঁই পায় না। জীবনের দাম হিসেবে মৃত্যুতে তার সত্তা সমর্পণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ অযথা সংশয়ী। ইতিমধ্যে তিনি সোনার তরীতে আরোহী। মহা অজানার দেশে তাঁর যাত্রা শুভ হোক, সেই কামনা করি।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমসাময়িক লেখক। আমরা তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করি, উপভোগ করি। সাহস ও প্রতিরোধের নাটক হিসেবে আমরা ডাকঘর মঞ্চস্থ করতে পারি। ১৯৪০ সালে প্যারিসের পতনের আগ মুহূর্তে রেডিও ফ্রান্স যথার্থভাবেই এই নাটকটি প্রচার করেছিল। একবার হোসে অর্তেগা ই গাসেত যথার্থই বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে অমলের মতো রাজার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে না।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-দেবতার কাছ থেকে অপূর্ব সব সুন্দর পত্র আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
দূরপ্রাচ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আগ্রহের লক্ষণীয় পুনর্জাগরণ ঘটেছে। বিশ্বের দিকে চীন তার দুয়ার খুলে দেওয়ার পর সেখানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আগ্রহের নবায়ন ঘটেছে। সম্প্রতি তোং ইয়ু ছান, ওয়ে লিমিং এবং ইয়াও ওয়ে মিং নামের যে তিনজন চীনা পণ্ডিতের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের রচনাসমগ্র চীনা ভাষায় শিগগির অনূদিত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জাপান নবজাগরণের বাণী পায়। ২৫ বছর আগে জাপানি পণ্ডিত কাজুও আজুমা আমার বাড়ি বেড়াতে আসেন। আমার বইয়ের শিরোনাম তাঁর বিশাল রেজিস্ট্রি খাতায় টুকে নেন। গত বছর আমাদের বাংলা একাডেমী তাঁকে বিশিষ্ট ফেলো করেছে। রবীন্দ্রনাথ জাপানকে ভালোবাসতেন; ভালোবাসতেন সেখানকার মাটি ও কুটির, চিত্রশিল্প আর হাইকু। তাঁর মেয়ে মিরাকে লেখা পত্র থেকে জানা যায়, তিনি শান্তিনিকেতনে একটি জাপানি কুটির নিয়ে আসতেও প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। সম্প্রতি ফুকুশিমা-দাইচি পারমাণবিক স্থাপনায় বিপর্যয়ের কারণে জাপানকে খুবই ভুগতে হচ্ছে। সম্মানিত সভাপতি, জাপানে নিহত ও তাদের শোকার্ত আত্মীয়-স্বজনের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আমরা দাঁড়িয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করতে পারি?
বিদেশি বন্ধুরা, আপনারা এ দেশে আবার আসবেন। এটি রবীন্দ্রনাথের আরেক দেশ, যাকে তিনি বলতেন বাংলার বাংলা।
১ মে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কনটেমপোরেরাইজিং টেগোর অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ প্রদত্ত ইংরেজি ভাষণের অনুবাদ
২৫ এপ্রিল ২০১১
l মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক প্রধান বিচারপতি
0 comments:
Post a Comment