পানিতে ডুবে আছে এমভি শরীয়তপুর-১। আর পানির ওপরে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। সেটিকে ঘিরে কিছু ট্রলার-নৌকা। তাতে শত শত মানুষ। ডুবুরিরা এক একটি ডুব দেন আর মানুষ অধীর অপেক্ষায় থাকে। কিছুক্ষণ পর ডুবুরিরা তুলে আনেন একটি লাশ। চারপাশের মানুষের চোখ ভিজে যায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, এরপর বিকেল। সন্ধ্যা নেমে রাত আসে, তবু চলতে থাকে উদ্ধার অভিযান আর স্বজনদের অপেক্ষা। এখনো যে অনেকেই পায়নি প্রিয়জনের লাশ। গতকাল মঙ্গলবার এমন পরিবেশই ছিল গজারিয়ার চর রমজান বেগ এলাকার কাছে মেঘনা নদীতে। একে তো স্বজন হারানোর বেদনা, তার পরে লাশের জন্য অপেক্ষা।
রুস্তমের পাটাতনে দাঁড়িয়ে উদ্ধার অভিযান দেখতে দেখতে কাঁদছিলেন এক যুবক। নাম জানালেন বাবুল হোসেন। বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে। জানালেন, এখনো নিখোঁজ তাঁর ভাই হাবিবুর রহমান। বাবুল জানালেন, সকালে যখন তিনি লঞ্চ ডোবার কথা শুনলেন, তখনই ভাইয়ের মুঠোফোনে ফোন দেন। কিন্তু ফোন বন্ধ। এর পরই তিনি শরীয়তপুর থেকে ছুটে আসেন এখানে। অপেক্ষা করছেন ভাইয়ের খোঁজের।
ছেলেকে খুঁজছেন বাবা আলম মিয়া। জানালেন, তাঁর ছেলে শিমুল এই লঞ্চেই ছিল। কিন্তু এখনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
ঢাকার ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছরই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ফারদিন আলম। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের ওপর সেই দুপুর থেকেই বসে আছে সে। তাঁর বাবা মেজবাউল আলম (৪৫) এই লঞ্চেই ছিলেন। ফারদিন প্রথম আলোকে বলে, ‘বাবা গ্রামে গিয়েছিলেন কাজের জন্য। সেখান থেকেই ঢাকায় আসছিলেন...’ ফারদিনের কথা আর শেষ হয় না, তাঁর চোখ ভিজে আসে।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইতালি-প্রবাসী সুমন (২৪)। সাত বছর পর এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসে বিয়ে করেন। আজ বুধবার তাঁর আবার ইতালি ফেরার কথা ছিল। সে জন্যই ঢাকায় আসছিলেন তিনি। স্বামীকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন নববধূও। তাঁদের কারোরই খোঁজ মিলছে না।
বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্টের সম্প্রচার বিভাগের কর্মী মামুন চৌধুরী। কোনো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের কাজে নয়, তিনি এখানে এসেছেন স্বজনদের খোঁজে। রুস্তমের পাটাতনে সেই সকাল থেকেই বসে আছেন। মামুন জানালেন, এই লঞ্চেই ছিলেন তাঁর বড় ভাই মাসুদ চৌধুরী, ভাবী পান্না, ভাতিজা মাহির, চাচাতো ভাই শিমুল চৌধুরী, ফুফু সাগরিকা চৌধুরী ও ফুফা। সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখনো কারও খোঁজ মেলেনি।
ট্রলারে বসে ভাইয়ের লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কাজল। হঠাৎ ডুবুরিরা একটি লাশ তুলে আনলেন। কাজল শুরু করলেন কান্না। জানালেন, এই লাশের নাম রিংকু। রিংকুর সঙ্গেই ছিল তাঁর ভাই আমিন। কিন্তু আমিন কই?
স্বজনের লাশের জন্য এভাবেই অপেক্ষা করছে আরও অনেকে। কেউ কেউ উদ্ধারকাজ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। মিজানুর রহমান জানালেন, ‘তাঁর খালা মাজেদা বেগম এই লঞ্চে ছিলেন। সকাল থেকে বসে আছেন। কিন্তু উদ্ধারকাজে চরম ধীরগতি। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘খালার দুই দিন আগে আমার বাসায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ থাকায় আসতে পারেননি। আর এ কারণেই লঞ্চে অনেক ভিড় ছিল। আমি এর বিচার চাই।’
মেঘনায় যখন স্বজনেরা প্রিয়জনের লাশের অপেক্ষায়, তখন মেঘনাতীরের গজারিয়ায় চলছে মাতম। উদ্ধার করা লাশগুলো সেখানে নেওয়ার পর শনাক্তকরণের কাজ চলছে। এক ছেলের লাশ শনাক্ত করে ইব্রাহিম গায়েন মাতম শুরু করেন। তিনি জানান, তাঁর দুই ছেলে রতন ও রহিম ওই লঞ্চে ছিল। এক ছেলের লাশ পেয়েছেন। আরেকজন নিখোঁজ। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment