উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে সাতজন শিশু, নয়জন নারী ও ২০ জন পুরুষ। এখনো নিখোঁজ রয়েছে দুই শতাধিক যাত্রী। দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীদের বাড়ি শরীয়তপুরের বিভিন্ন গ্রামে।
মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মাহফুজুল হক বলেন, ‘রাত ১২টা পর্যন্ত ৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্যমতে, সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। পথে রাত ১০টার দিকে কাচিকাটা লঞ্চঘাট থেকে আরও শতাধিক যাত্রী ওঠে। তখন লঞ্চে ৪০০ বস্তা শুকনা মরিচ ওঠানো হয়। রাত আড়াইটার দিকে গজারিয়ায় চর রমজান বেগ এলাকায় পৌঁছালে একটি মালবাহী জাহাজ লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। লঞ্চটি মেঘনার ৭০ ফুট নিচে তলিয়ে যায়। এ সময় অনেকে লঞ্চ থেকে নদীতে লাফ দেয়। এর মধ্যে ৩০-৩৫ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করতে পারে চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী মিতালী-২ লঞ্চ। আরও ৪০-৫০ জন যাত্রী বিভিন্নভাবে তীরে উঠতে সক্ষম হয়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার গুলজার আহমেদের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি ডুবুরি দল লাশ উদ্ধার কার্যক্রম চালায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত তারা ৩১ জনের লাশ উদ্ধার করতে পারে। বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম রাতে সাংবাদিকদের বলেন, আলোকস্বল্পতা ও উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা না পৌঁছানোয় রাত আটটা থেকে আজ ভোর ছয়টা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ স্থগিত থাকবে।
এ ঘোষণার পরও নৌবাহিনীর ডুবুরি দল রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আরও পাঁচটি লাশ উদ্ধার করে। ১১টার দিকে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা ঘোষণা দেন, রাতে আর কোনো অভিযান চালানো হবে না।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই লঞ্চে দুই থেকে আড়াই শ লোক ছিল বলে আমরা জেনেছি। এর মধ্যে ৪০-৫০ জন সাঁতরে তীরে উঠেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ৩১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান চলছে।’
লাশ উদ্ধারের পরপর তা রাখা হচ্ছিল গজারিয়ার চরকিশোরগঞ্জের তীরে। নিহত ও নিখোঁজ যাত্রীদের শত শত স্বজন করতে থাকেন অপেক্ষা। রাত ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন।
উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয়: নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ জনের পরিচয় মিলেছে। তাঁরা হলেন: এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চের সুকানি নড়িয়ার সুরেশ্বরের সাদেক আলী (৫৫), কাটাতুলি এলাকার মিলন (২২), বাদশা মাঝি (৩২), হাসিনা বেগম (৫০) ও তাঁর মেয়ে কুলসুম বেগম (৩২), মিনারা বেগম (২২) ও আবুল কাশেম, একই জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার শবনম (২০), বদরুননেছা (৫০), আলমগীর মাসুক (৫০), আবদুল লতিফ বিপ্লব (২৮), আকাশ (৩২), ডিঙ্গাখালী এলাকার হানিফ (৪০), ঢাকার মালিবাগের পারভেজ (১২), নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রুবেল ও দিওয়ানা (৭), যশোরের তুষার (৩৫) এবং চাঁদপুরের বাকেরপুরের সালাউদ্দিন (৪০)।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য: নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে আমি ও আরেকজন কেবিনের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ি। রাত দুইটার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। কেবিনের দরজা খুলতেই দ্রুত পানি ঢুকতে থাকে। আমরা দুজন কোনোমতে লঞ্চ থেকে বের হয়ে দেখি মরিচের বস্তা। সেটি কোনোমতে ধরে দুজন রক্ষা পাই। কিছুক্ষণ পর চাঁদপুরের এমভি মিতালী-২ নামের একটি লঞ্চ এসে আমাদের উদ্ধার করে। ওই লঞ্চের লোকজন আরও ৩০-৩৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে।’
নড়িয়ার পণ্ডিতসার এলাকার মো. দুলাল দেওয়ান বলেন, ‘রাতে হঠাৎ একটি জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা মারলে লঞ্চটি উল্টে যায়। কীভাবে যেন আমি তখন লঞ্চের তলায়। একটু পর চাঁদপুরের একটি লঞ্চ এসে তাদের লঞ্চের বয়া ফেলে আমাকে উদ্ধার করে।’
অতিরিক্ত যাত্রী: এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ছিল বলে বিআইডব্লিউটিএ ও যাত্রীদের সূত্রে জানা যায়। দিনে ৩৩২ জন ও রাতে ২২৫ জন যাত্রী বহন করার অনুমোদন ছিল লঞ্চটির।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী শরীয়তপুরের খালিদ হাসান ও লিটন মিয়া বলেন, লঞ্চে চার শতাধিক যাত্রী ও অনেক মাল বোঝাই করা হয়েছিল।
তবে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণ হিসেবে অনেক যাত্রী জানান, ১২ মার্চ ঢাকায় চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে দুই দিন বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের চাপ ছিল বেশি। এ কারণে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মালবাহী জাহাজের চলাচল: রাতে নৌপথে দুর্ঘটনা এড়াতে দুই বছর আগে নদীতে মালবাহী কার্গোসহ যেকোনো ধরনের জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। কিন্তু সোমবার রাতে শরীয়তপুরের লঞ্চকে ধাক্কা দেওয়া মালবাহী জাহাজটি তা অমান্য করেই চলেছিল।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে মালবাহী জাহাজ চলাচল করায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে শরীয়তপুরের লঞ্চটি ঢাকায় আসছিল। আমরা যদি এসব বিষয়ে সচেতন না হই, শুধু আইন করে কি বন্ধ করা সম্ভব?’
লঞ্চের ফিটনেস: এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চ ১৯৯১ সালে নির্মিত হয়। এর মালিক লুৎফর রহমান। ফিটনেসের মেয়াদ আগামী ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ৬১ মিটার, প্রস্থ ৮ দশমিক শূন্য ৫ মিটার ও গভীরতা ২ দশমিক শূন্য ৪ মিটার। সমুদ্র পরিবহনের এক কর্মকর্তা দাবি করেন, লঞ্চটির ফিটনেস ঠিকই ছিল।
জাহাজটি শনাক্ত হয়নি: যে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবল এবং এত লোকের প্রাণহানি ঘটল, গতকাল রাত পর্যন্ত জাহাজটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যাত্রীদের কেউ বলেছেন, একটি তেলবাহী ট্যাংকার লঞ্চটিকে ধাক্কা মারে। কারও মতে, একটি বালুবাহী জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে গেছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, কোন জাহাজটি লঞ্চটিকে ধাক্কা মেরেছে, তা শনাক্ত করা যায়নি। আশা করছি, শিগগিরই জাহাজটির সন্ধান পাওয়া যাবে।’
উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতি: নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনেরা বলেন, লঞ্চের ভেতরে অনেক লাশ। উদ্ধার করা গেলে ওই সব লাশ পাওয়া যাবে। মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, ওই লঞ্চের কেরানি ইলিয়াস হোসেন (২৭) তাঁর চাচাতো ভাই। তাঁর খোঁজে সকাল থেকে বসে আছেন। কিন্তু উদ্ধারকাজে চরম ধীরগতি।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘লঞ্চটিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তা পানির নিচে ১২০ টনের বেশি ওজন অবস্থায় রয়েছে। অথচ উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের ধারণক্ষমতা মাত্র ৬০ টন। আরেক উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার ধারণক্ষমতা ৬৫ টন। রাত আটটার দিকে হামজা এলে দুটি জাহাজ মিলে লঞ্চটিকে টেনে তোলা সম্ভব হবে।’ তবে রাত ১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি হামজা।
তিনটি তদন্ত কমিটি: দুর্ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক হলেন অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব বায়তুল আমিন। বিআইডব্লিউটিএর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের সদস্য (অপারেশন ও প্ল্যানিং) মতিউর রহমান। আর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক হলেন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ মেডিকেল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন জসিম উদ্দিন সরকার। তাঁদের আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তিনটি তদন্ত দলের সদস্যরা গতকালই ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
শরীয়তপুরে ক্ষোভ: দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনেরা গতকাল বেলা তিনটার দিকে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সুরেশ্বর লঞ্চঘাটে বিক্ষোভ করে। নড়িয়ার গুলমাইজ গ্রামের আলী হোসেন ছৈয়াল বলেন, ‘দুর্ঘটনায় আমাদের ১৫ আত্মীয় নিখোঁজ। অর্থাভাবে দুর্ঘটনাস্থলেও যেতে পারিনি। স্থানীয় প্রশাসন দুর্ঘটনাস্থলে লাশ আনতে আমাদের পাঠানোরও ব্যবস্থা করেনি। তারাও যায়নি। এর প্রতিবাদে আমরা সুরেশ্বর লঞ্চঘাটে বিক্ষোভ করেছি।’
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবি আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই মুন্সিগঞ্জের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়ায় আমরা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।’
ক্ষতিপূরণ: দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শরীয়তপুর-২ আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ এম ইদ্রিস আলী, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক আজিজুল আলম ও পুলিশ সুপার মো. সাহাবুদ্দিন খানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত হন। এ সময় নৌপরিবহনমন্ত্রী নিহত যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা ও একই পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হলে ৪৫ হাজার টাকা এবং দাফন ও সৎকারের জন্য আরও অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন।
দুর্ঘটনায় শোক: লঞ্চডুবির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার আবদুল হামিদ, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। prothom-alo
0 comments:
Post a Comment