নাই যে তা বোঝাতে ফকির লালন সাঁই প্রবর্তিত বাৎসরিক সাধন অনুষ্ঠানের ঠিক আগে আগে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারত না। এবার মাগুরার শালিখা উপজেলায় লালন স্মরণোৎসবে হামলা করে বাউলদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে অনুষ্ঠানের মঞ্চ, থুতু দেওয়া হয়েছে লালনের ছবিতে। কত জায়গায় কতভাবে যে তাঁদের নিগৃহীত হতে হয়, তার খোঁজ কে রাখে? কেবল ভাবি, শহুরে একাডেমি, নিকেতন, ইনস্টিটিউটে আর বাজারে যাঁদের প্রতিষ্ঠা, তেমন কোনো সাংস্কৃতিক ঘরানার মানুষজনের সঙ্গে এমনটা করে কেউ পার পেত কি? দিকে দিকে রব উঠত না? লালনের আর তাঁর অনুসারীদের বেলায় যেন তেমনটা হওয়ার নয়। তাঁরা বরাবরই নির্যাতনের শিকার।
লালন কৃষক শ্রেণীর মনের মানুষ, গ্রামগঞ্জে এখনো তাঁর মতের পথিকদের সংখ্যা অগণিত। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির নাম-নিশানা এবং বাংলার ভাবুকতার থই পেতে লালনের নিরিখ আমাদের লাগবেই। তাঁর মধ্য দিয়ে কয়েকশ বছর পুরোনো এক ভাবান্দোলন শিখরে উঠেছিল, মানবজীবনকে আরও অর্থপূর্ণ করার এক দার্শনিক চর্চা বিকাশ পেয়েছিল। তাঁকে এত সহজে পায়ে দলা যায়? তাঁর উত্তরসূরিদের এমন কুৎসিত লাঞ্ছনা করা চলে?
যখন এ দেশে ইংরেজও আসেনি, যখন ইউরোপজুড়ে চলছিল ধর্ম নিয়ে হানাহানির অন্ধকার যুগ, তখন বাংলায় এক মানবতাবাদী জাগরণ ঘটে যাচ্ছিল। একদিকে সুফি-দরবেশেরা, অন্যদিকে চৈতন্যদেবের অনুসারীরা জাত-পাত-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা পুরে দিচ্ছিলেন মানুষের মনে। ভোগ-মোহ-বাসনায় জর্জরিত মানুষকে সমাজব্যবস্থার ফাঁকি ও দেউলিয়াপনা তাঁরা ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। বিভিন্ন জনপদে ও সমাজে অজস্র সমাজ-সংস্কারক, সাধকপুরুষ ও সাধ্বী নারীর আবির্ভাব হয়েছিল। আমরা পেয়েছি চিন্তা, ভাব আর সৃজনের অপরূপ এক সিলসিলা। এদেরই শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ফকির লালন সাঁই।
ভাবতে অবাক লাগে, শহর কলকাতা যখন বিত্ত আর সাম্রাজ্যের ঘাঁটি, সেখানে যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রতিভাধর মানুষের আবির্ভাব, তখন এসবের প্রভাবের বাইরে, কুষ্টিয়ার গ্রামাঞ্চলে লালন কী বিরাট কাণ্ডটাই না ঘটাচ্ছিলেন! এই বাউল-সাধকদের দিশা ধরেই কৃষক সমাজের মধ্যে চলছিল এক দেশজ জাগরণ। ব্রিটিশরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতাই ‘রেনেসাঁর’ আলো পাশের গ্রামে পৌঁছতেই যেখানে শত বছর লেগে গিয়েছিল, সেখানে গ্রামের বাউলেরা জাগাচ্ছিলেন গণমানুষকে। অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছিল অজস্র পালা-গাথা ও গীতিসাহিত্য। বাংলা ভাষা এদের হাতেই নতুন জীবন পেয়েছিল। আমাদের নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি ও শিল্পে এখনো তার ছাপ জ্বলজ্বলে। পনেরো শতকের সুলতানি আমল থেকে ইংরেজ আসার আগ পর্যন্ত সেই সময়েই বাংলার কৃষি সমাজ সুগঠিত হচ্ছিল, সঙ্গে চলছিল সাংস্কৃতিক জাগরণের জোয়ার। গণমানুষের সন্তান বাউলেরাই আমাদের লোকায়ত সক্রেটিস, লালনের ভাষায় ‘সহজ মানুষের’ আদর্শ নারী-পুরুষ। গ্রামীণ সমাজে জাতপাতবিরোধী এবং নারীমুক্তির সংগ্রাম তাঁরা যতটা চালিয়েছিলেন, আজও তা করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুলের কথা যাঁরা জানেন না, সেসব মানুষও কিন্তু লালনের গান শোনেন এবং বোঝেন। এঁদের কল্যাণেই আমরা বলতে পারি, ‘উদার বাঙালি সংস্কৃতি’র কথা। অন্যদিকে, এঁদের বিরোধীরাই মানুষকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখার জন্য প্রচার করেন। ধর্ম তাঁদের কাছে ভয় দেখানোর বিষয়, মনুষ্যত্বের বিষয় নয়।
আর কিছু না হোক, লালনের চিন্তাধারা কেউ মানি বা না মানি, বাংলা ভাষায় যে এত গভীর চিন্তাচর্চা আর ভাবের লীলা সম্ভব, লালন ছাড়া তা কি আমরা জানতাম? সত্যিকার বাংলা সংস্কৃতির মন ও মেজাজ যেখানে ছড়িয়ে আছে, তাকে আমরা তথাকথিত লোকসাহিত্য বলে নিম্নপদস্থ করে রেখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তো তাঁর ‘বাংলার বাউল’ নামের লেখায় বলেছেন, ‘আমাদের ভাব, আমাদের ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙ্গালী যেখানে হূদয়ের কথা বলিয়াছে, সেইখানে সন্ধান করিতে হয়।’ সেই সন্ধানের খাতিরে বাউলদের পদধূলি লাগবেই। মুখের ভাষা ব্যবহার করে, প্রতাপশালী শাস্ত্রগুলোর সঙ্গে লড়াই করে মানবের মর্মের কথাটা মানুষের মনে গেঁথে দিতে পারা কি কম কথা? যুগ যুগ ধরে জনসমতলে লালন সাঁইয়ের মতো ভাবুকেরা যতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছেন, আমাদের গণমাধ্যম আর ছাপাখানার দৌলতে দৌলতবান অনেকেও সেটা পারেননি। বানের পানি যেমন পলি রেখে চলে যায়, আঠারো-উনিশ শতকের এই ভাবপ্লাবন জনমনে সে রকম একটা সাংস্কৃতিক পরত ফেলে গেছে। এর শক্তি ও সৌন্দর্য আজও জীয়ন্ত বলেই মানুষ আজও লালনকে মান্য করে, ছেঁউড়িয়ায় তাঁর আখড়াকে ভালোবাসে আর গ্রামে-গ্রামান্তরে মার খেয়েও বাউলেরা লড়ে যায়।
কালের পাকেচক্রে পড়ে আমরা এই সিলসিলা হারিয়ে আর পথে আসতে পারিনি। এই ক্ষতির বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট্-পালট্ করিতেছ, কেবল একবার হূদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই।’ হ্যাঁ, কৃষকগীতি আর বাউলগানে সেই হূদয়ের প্রাণভোমরা লুকানো ছিল। এই সাংস্কৃতিক বিপর্যয়েরই শিকার বাউলেরা। তাঁদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁরা হারাতে থাকেন আশ্রম, মাজার, আখড়া ও সাধুসঙ্গের ঠাঁই। একসময় জমিদারেরা তাদের নির্যাতন করেছে, মোল্লা-পুরোহিতেরা তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, আমলাতন্ত্র তাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্পনসরের নামে আখড়া-আশ্রম-মাজার প্রাঙ্গণে বাউল তাড়ানো মেলা বসানোর হিড়িক। আর আমরা শহরে বসে কেবল মিছা বাউল বাউল করছি। এই ভড়ংকে পরিহাস করেই বিজয় সরকার গেয়েছিলেন, ‘বাউল করো তোমরা/ বাউল কি আর আছে?/ বড় দুঃখে বাংলার বাউল মইরাছে’। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন প্রবর্তিত দোল উৎসবের প্রভাতে এই বেদনা যেন আমরা অনুভব করি।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment