সেই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার এক অভাবী তরুণ। শুরু করেন কাঁকড়ার চাষ। এবং বাজিমাত।
সেই তরুণের সাফল্য দেখে সুবর্ণচরের অনেকেই শুরু করেন কাঁকড়ার চাষ। এখন সেখানকার হাজারো মানুষ এই বৃত্তিকে ঘিরেই সাফল্যের স্বপ্ন দেখছেন। সুবর্ণচরে কাঁকড়ার চাষকে দেখা হচ্ছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে।
সুবর্ণচরের সেই তরুণের নাম সুভাষ চন্দ্র সাহা। বয়স এখন চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে। সম্প্রতি সুবর্ণচরে গিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানা গেল তাঁর উদ্যোগ, পরিশ্রম আর সাফল্যের গল্প।
শুরুর গল্প: সুবর্ণচরের চর আমানউল্লা গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ চন্দ্র সাহা। অভাবের সংসারে জন্ম। কৈশোর থেকেই জড়িয়ে পড়েন বাবার মুড়ির ব্যবসার সঙ্গে। বাড়িতে মুড়ি ভাজার পর তা বাজারে বিক্রি করাই ছিল পেশা। কয়েক বছর মুড়ির ব্যবসা করেন তিনি, কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে ছেড়ে দেন মুড়ির ব্যবসা। কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেন নানা জায়গায়। ওই সময় কারও কাছ থেকে খুলনা-সাতক্ষীরা এলাকায় খামার করে কাঁকড়া চাষে সাফল্যের গল্প শোনেন। বিষয়টি তাঁর মনে ধরে। চিন্তা করেন, তাঁর এলাকায়ও তো এ রকম কিছু হতে পারে।
সেই ভাবনা থেকে প্রথম দিকে শিকারিদের কাছ থেকে কাঁকড়া কিনে স্থানীয় ও ঢাকার বাজারে বিক্রি শুরু করেন। লাভটা একেবারে মন্দ হয় না। তাই কাঁকড়া চাষের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় বেশখানি।
নতুন সংগ্রাম: সুভাষ প্রথম দিকে চর এলাকায় খালি জায়গায় সাগরের লোনা পানি আটকে তাতে কাঁকড়ার চাষ শুরু করেন। সাফল্যও আসতে থাকে। কিন্তু চরে দস্যুদের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প পথ তাঁকে ভাবতে হয়। একসময় বাড়ির সামনের ডোবায় পানি জমিয়ে তাতে বাজার থেকে লবণ কিনে এনে মিশিয়ে দেন। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানেই শুরু করেন কাঁকড়ার চাষ। ভালোই ফল পান এতে। এর পর থেকে বাড়ির আশপাশের ডোবায় কাঁকড়ার চাষ শুরু করেন। আর পিছু তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর খামারের আয়তন।
এখন সুভাষের গ্রামের বাড়িতে এক একর জমিতে পাঁচটি ছাড়াও ভূমিহীন বাজার ও হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে এক একর করে আরও দুটি কাঁকড়ার খামার আছে। নদী থেকে শিকারিদের দিয়ে কাঁকড়া ধরিয়ে এনে খামারগুলোতে চাষ করেন। ১৫ থেকে ২০ দিন লালন-পালনের পর সেগুলো বিক্রি করা হয়।
সংগ্রাম করে সাফল্য পাওয়া সুভাষ আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আগে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। কারও কাছে ধারও পাওয়া যেত না। এখন বললেই যে কেউ ১০-১২ লাখ টাকা ধার দেন।’ জানালেন, কাঁকড়া চাষ করে দুটো পিকআপ ভ্যান কিনেছেন। পাঁচ একর জমিতে কাঁকড়ার খামার করতে পেরেছেন। অভাবের কারণে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও তিনি ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন।
কাঁকড়া সংগ্রহ: শিকারিরা সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়জন দল বেঁধে মেঘনা নদীতে চলে যান। নদীতে সপ্তাহ খানেক থাকতে হয়। জোয়ার-ভাটার সময় গভীর সমুদ্র থেকে নদীতে আসা ছোট-বড় সব কাঁকড়া সংগ্রহ করেন শিকারিরা। এরপর সেগুলো আড়ত বা খামারে পাঠানো হয়।
বিপুল কর্মসংস্থান: কাঁকড়ার চাষ ও ব্যবসায় সুভাষের কেটে গেছে ১৭ থেকে ১৮ বছর। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ছোট ভাই বিহাব চন্দ্র সাহাও। তাঁদের দেখাদেখি এলাকার আরও অনেকেই এখন কাঁকড়ার চাষ করছেন। সুভাষের দেওয়া তথ্যমতে, সুবর্ণচরে বর্তমানে কাঁকড়াচাষির সংখ্যা ১৩ জন। ছোট চাষিও আছেন অনেক। নদী থেকে কাঁকড়া ধরে চাষিদের খামারে কাঁকড়া সরবরাহ করে বেঁচে আছেন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ।
কাঁকড়া শিকারে জড়িত চর আমানউল্লা গ্রামের ধনেশ্বর মজুমদার, হারাধন মজুমদার, অরুণ মজুমদার, বিপন মজুমদার, নেপাল মজুমদার, হিমাংশু মজুমদার ও শ্যামল মজুমদার। সুভাষের খামারে কাঁকড়া ধরার কাজ করছিলেন তাঁরা। এ সময় কয়েকজন জানালেন, কাঁকড়া শিকারই তাঁদের পেশা। প্রতিদিন গড়ে তাঁরা ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন।
কাঁকড়া শিকারি ধনেশ্বর বলেন, ‘কাঁকড়া চাষ শুরু হয়েছে বলেই আমার মতো অনেকের রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে। পরিবার নিয়ে বেঁচে আছি। আমার মতো অনেকেই এর ওপরই নির্ভরশীল।’
সুবর্ণচরে কাঁকড়া কেনাবেচার পাঁচটি বাজার হলো: ঘোষ ফিল্ড, চরবাটা, দাসেরহাট, খাসেরহাট ও স্বপন মার্কেট। এসব বাজারে রয়েছেন অন্তত ২০ জন আড়তদার। তাঁরা শিকারিদের কাছ থেকে কাঁকড়া কিনে স্থানীয় খামারি ছাড়াও ঢাকার পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন।
সমস্যা: মাঝেমধ্যে কাঁকড়ায় মড়ক লাগে। তখন লবণমিশ্রিত যে পানিতে কাঁকড়া ছাড়া হয়, ওই পানি এবং মাটি শুঁকে (নাক দিয়ে গন্ধ পরীক্ষা করে) ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পানি ও মাটিতে গন্ধ পাওয়া গেলে তখন দ্রুত পানি পরিবর্তন করা হয় কিংবা চুন মেশানো হয়। এসব কাজই চাষিরা করেন নিজেদের মতো করে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় মৎস্য বিভাগের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পান না চাষিরা।
সুবর্ণচরের কচ্ছপ মার্কেট এলাকার কাঁকড়াচাষি হরি কাহার জানালেন, সুভাষের সাফল্য দেখে তিনিও কাঁকড়ার চাষ শুরু করেন। লাভ ভালোই। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রোগে কাঁকড়া মরে যায়। এ ছাড়া অনেক সময় ঢাকার বাজারে পাইকারেরা সঠিক দাম দিতে চান না। তাই কম লাভেও কাঁকড়া বেঁচে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা। পাশাপাশি কাঁকড়ার চাষ করতে গিয়ে মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলো সমাধানে মৎস্য বিভাগের সহায়তা কামনা করেন তাঁরা।
আশ্বাস: নোয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিলকিস তহমিনা জানান, কাঁকড়া চাষের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া চাষিরা চাইলে তাঁদের সহায়তা দেওয়া হবে।
0 comments:
Post a Comment