সাক্ষাৎকার পর্ব শেষে আমরা এসেছি রাস্তায়, কোহিনূরের ছবি তোলার জন্য। ছবি নেওয়া হচ্ছে, ক্যামেরার সামনে হাসি মুখে কোহিনূর। ঠিক সে সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল দুই পথশিশু। একজনের বয়স ৯ কি ১০, আরেকজনের দুই অথবা তিন। ৯-১০ বছর বয়সীর কোলে দুই-তিন বছরের ছোট বোন। নাকে সর্দি, হাতে পাউরুটি, চোখে রাজ্যের বিস্ময়। দুই শিশুকে দেখেই কোহিনূরের আবদার, ‘ওদের সঙ্গে ছবি তুলব, ওদের সঙ্গে ছবি তুলব!’ কাছে ডাকতেই খানিকটা আড়ষ্ট দেখাল বড় বোনকে। তবে ছবি তোলায় কোনো অনাগ্রহ নেই। ‘নাম কী এই পিচ্চি বাবুটার?’, প্রশ্ন করলেন কোহিনূর। বাংলায় বুঝিয়ে বলার পর বড় বোন জানাল, ‘ওর নাম সোনিয়া।’ সোনিয়াকে কোলে নিলেন কোহিনূর। ছবি তুলছেন আলোকচিত্রী। সন্ধ্যার আঁধারে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বারবার আলোকিত করছে সবার মুখ। ছোট্ট সোনিয়ার ওদিকে খেয়াল নেই; সে কেবল বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অচেনা মানুষটির মুখের দিকে, যে তাকে কোলে নিয়েছে। একসময় কী হলো, হঠাৎ সে আধো আধো বুলিতে ডেকে উঠল ‘আপা, আপা’ বলে! ইংরেজিতে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর কোহিনূর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। রাস্তার নিয়ন আলোয় মুহূর্তের জন্য কি ঝিকমিক করে উঠল কোহিনূরের সজল চোখ জোড়া?
অনাথ আশ্রম থেকে নরওয়ে
কাকতালীয় হলেও অবুঝ সোনিয়ার উচ্চারণ তো সত্যিই! কোহিনূর তো আসলেই আমাদের সবার বোন। যে বোনের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মলগ্নে। কোহিনূরের মায়ের পরিচয় আমরা জানি না; বাবা কে, তা-ও জানা যায়নি। আমরা জেনেছি, তিনি যুদ্ধশিশু। যুদ্ধশিশু কোহিনূর এখন অনেক বড়, প্রায় বাংলাদেশের সমান বয়স তাঁর। থাকেন নরওয়েতে। সে দেশে নাম করেছেন সংগীতশিল্পী হিসেবে। গত ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশি কোহিনূর এসেছেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। বিজয়ের এই মাসে তিনি এসেছেন আমাদের গান শোনাতে।
বলা বাহুল্য, জন্মের সময়কার কথা কিছুই মনে নেই কোহিনূরের। কোহিনূর কেবল মনে করতে পারেন তিন বছর বয়সের ঝাপসা স্মৃতি, ‘বয়স তখন তিন হবে। রাস্তা থেকে এক সাদা চামড়ার ভদ্রলোক আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন। নাম ছিল তাঁর ডা. জ্যাক। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মাদার তেরেসার অনাথ আশ্রমে। বিশাল এক পরিবারের সদস্য হলাম আমি। ভালোই কাটছিল দিনগুলো। মনে পড়ে ওয়াজেদ ও লরা নামের দুজনের কথা। খুব যত্ন করতেন আমাদের। ডা. জ্যাকও খুব আদর করতেন।’ তবে বিশাল ওই পরিবারে বেশি দিন থাকা হলো না কোহিনূরের। ছয় মাস বাদে একদিন ডা. জ্যাক এলেন তাঁর কাছে। বললেন, নরওয়ে নামের এক দেশে যাবে তুমি, সেখানে মা-বাবাও পাবে। যাবে, কোহিনূর? সাড়ে তিন বছরের কোহিনূর মাথা নাড়ল, না, যাব না আমি! কেন?
‘মাদার তেরেসার অনাথ আশ্রম আমার কাছে পরিবারের মতো হয়ে উঠেছিল। সবার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেশ রাজি হতে হলো।’ আলো-আঁধারি এক পরিবেশে পুরোনো দিনের কথা বলছিলেন কোহিনূর। আমরা যেন ফিরে গিয়েছিলাম সেই অনাথ আশ্রমে। যেখানে অনেক শিশুর ভিড়ে বসে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে। কোহিনূর নামের সেই ছোট্ট মেয়েটা সত্যি সত্যি একদিন নরওয়ে নামের একটা দেশে চলে গেল। দিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ১৪ জুলাই।
নতুন পৃথিবী
নরওয়েতে গিয়ে মা-বাবা পেলেন কোহিনূর, পেলেন বড় এক ভাইকে। দত্তক মায়ের নাম অডি নোর্ডবার্গ, বাবা নিল্স নোর্ডবার্গ আর ভাইয়ের নাম নিল্স জুনিয়র। নতুন একটা নামও পেলেন কোহিনূর, ‘আমার নাম রাখা হলো মারি। মারি কোহিনূর নোর্ডবার্গ। মারি নামে ডাকলেও কোহিনূর নামেই আমি স্বচ্ছন্দ এবং গর্বিত। লোকে যখন আমার এই নাম শুনত, জিজ্ঞেস করত, কেন এমন নাম? তখন সবাইকে আমার ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে হতো। কোত্থেকে এসেছি, কীভাবে এসেছি ইত্যাদি। তবে সব সময় বাংলাদেশের কথা বললে আমার গর্বই হতো, এখনো হয়।’ মা-বাবার অভাব কখনোই বোধ করেননি কোহিনূর। নতুন মা-বাবা তাঁকে ভরিয়ে রেখেছেন আদরে-স্নেহে-শাসনে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর চমৎকার সম্পর্ক। ‘দত্তক মা-বাবাকে নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত। নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন আমাকে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বড় ভাগ্যবান আমি। আজ যে আমি এই পর্যায়ে এসেছি, তার পুরো কৃতিত্ব আমার মা-বাবার।’ বলছিলেন কোহিনূর।
সুরের কোহিনূর
নরওয়েতে গিয়ে মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই নাচের তালিম নেওয়া শুরু করলেন কোহিনূর। অংশ নিতে লাগলেন বিভিন্ন স্টেজ শোতে। এভাবেই বিনোদন দুনিয়ায় পথচলা। ১৯৯৬ সালে পড়াশোনা শেষ করলেন অসলোর স্টেট একাডেমি অব ব্যালে থেকে। নৃত্যেই শুরু করলেন ক্যারিয়ার। তবে নাচতে নাচতে এবং নাচ শেখাতে শেখাতে একসময় গানের ভুবনেও পা রাখলেন আটঘাট বেঁধে। গঠন করলেন সাত সদস্যের একটা ব্যান্ড দল। যেখানকার সদস্যরা আবার একেক দেশের। (নামবিহীন এই ব্যান্ডকে নাকি অনেকেই কোহিনূর অ্যান্ড কোম্পানি নামেও ডাকে আজকাল!) তবে একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হলো তাঁকে প্রতিনিয়তই, ‘পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের চামড়ার রং নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি। আমার গায়ের চামড়া সাদা নয় বলে অনেকেই আড়চোখে তাকাত, এমনকি এখনো তাকায়। বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিত না। তাই ব্যান্ড দল গঠনের শুরুতে নানান মন্তব্য হজম করতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার পথে অবিচল এবং একসময় ঠিকই সবার নজরে পড়লাম। সবাই বলাবলি শুরু করল, কোহিনূর সত্যিই ভালো গায়।’ বর্ণবৈষম্যের কথা বলছিলেন কোহিনূর। বলছিলেন, সেই বাধা ডিঙিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার গল্প।
গান করে নাম কুড়াচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। সঙ্গে নাচেও এলেমদার। তার সঙ্গে যুক্ত হলো থিয়েটারে কাজ করার অভিজ্ঞতা। অভিনয়েও মুনশিয়ানা দেখালেন কোহিনূর। ডাক পেলেন টিভি ধারাবাহিকে। অভিনয় করলেন নরওয়ের জনপ্রিয় লেখক উন্নি লিন্ডেলসের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত গোয়েন্দা ধারাবাহিক হনিংফেলেনে (দ্য হানি ট্র্যাপ)। সেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মারিয়ান ডালের চরিত্রে অভিনয় করে পেলেন দারুণ জনপ্রিয়তা।
তবে গানটাকেই নেশা ও পেশা হিসেবে বেছে নিলেন কোহিনূর। নিয়মিত গান লিখতে শুরু করলেন, সুরও দিতে লাগলেন নিজেই। কোহিনূর বললেন তাঁর গানের কথা, ‘হিপ হপ এবং ওয়ার্ল্ড মিউজিক করি আমি। এ ছাড়া র্যাপ, রাগা, মাফিন, সোল, ব্লুজ এবং পপ ঘরানার গানও করি। আমার গান মূলত তরুণ, নারী ও শিশুদের জন্য। বড় কথা হলো, আমার গানে তুলে আনতে চাই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার কথা। গান আমার সবকিছু। আনন্দে গান করি আমি। রাগ হলে তা প্রকাশ করি গানে। কাঁদিও গানের মধ্য দিয়ে।’ বাংলা ও সোমালিয়ান ভাষায় একটা গান করেছেন কোহিনূর। গানের কথা এ রকম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি আবো (বাবা), আমি তোমাকে ভালোবাসি হয়ো (মা)...’ এই গান ভিন দেশে পাড়ি জমানো মানুষদের জন্য, যাঁরা কষ্টে থাকেন নিজের ভাষায় কথা বলতে না পেরে।
কোহিনূরের বাংলাদেশ
সাড়ে চার বছরের একটা মেয়ে আছে কোহিনূরের। নাম শাদিয়া। তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার দেশের নাম বলো তো? সে নাকি উত্তরে বলে, ‘আমার দেশের নাম বাংলাদেশ আর সোমালিয়া!’ সোমালিয়া বলে, কারণ ওর বাবা যে সোমালিয়ান। আলী হাজে মোহাম্মদ ফারাহ। ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ ক বছর আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কোহিনূরের। মেয়ের কথা তুলতেই মুঠোফোনে তোলা তার ছবিও দেখালেন তিনি, ‘বাংলাদেশে ওকে নিয়ে আসার ইচ্ছে আছে। অবশ্যই আসবে ও, কারণ এই দেশটা যে ওর মায়ের জন্মভূমি। আমরা কেউই যুদ্ধ চাই না। যাঁরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন, এর পেছনে টাকা ঢালছেন, তাঁরা কি পারেন না ওই টাকা দিয়ে অভুক্ত শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দিতে! অবশ্যই পারেন। কিন্তু করেন না। এই নীতি থেকে সরে আসতে হবে এবং আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, নতুন প্রজন্ম আর যুদ্ধ করবে না। অনাথ হবে না আর কোনো শিশু। আমরা একটা শান্তিময় পৃথিবী দেখতে চাই।’ বাংলাদেশে এসে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় গান করেছেন। পরিচালনা করেছেন সংগীতবিষয়ক এক কর্মশালা। গিয়েছিলেন মাদার তেরেসার অনাথ আশ্রমেও। দেখে এসেছেন সেখানকার শিশুদের।
কোন জাতীয়তায় পরিচিত হতে ভালো লাগে? প্রশ্নের উত্তরে কোহিনূরের হাসিমুখে উত্তর, ‘দুটোই। কারণ, নরওয়ে আমাকে আজকের কোহিনূর হিসেবে গড়ে তুলেছে। তবে আমার হূদয় কিন্তু বাংলাদেশেই!’ এর মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাও শিখে গেছেন কোহিনূর! সেদিন সন্ধ্যায় কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আমি বাংলাডেশকে ভালোবাসি!’
কোহি ডি ব্রাউনি
২০০৭ সালের ১ জানুয়ারিতে প্রথম অ্যালবাম কোহি ডি ব্রাউনি প্রকাশ করেন কোহিনূর। সেই অ্যালবামের ‘ভোডো ট্যাঙ্গো’, ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার’, ‘ডিল উইথ দ্য ডেভিল রেডিও’ এবং ‘শেক আওয়ার পম পম’ গানগুলো এখনো নরওয়ের তরুণদের মুখে মুখে ফেরে। (চাইলে গানগুলো শুনতে পারেন ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে।) প্রথম অ্যালবামের আগে কয়েকটি গান নিয়ে লোকাল অ্যানিসথেটিক নামের একটা প্লে-সিঙ্গেলও প্রকাশ করেন কোহিনূর। এ ছাড়া নিয়মিত শো করতে থাকেন নরওয়ের বিভিন্ন স্কুল, ইয়ুথ ক্লাব, পার্টি, উৎসব ও কনসার্টে। সঙ্গে আন্দোলনের মঞ্চেও গান গেয়ে সাধারণ জনগণের কথা তুলে ধরেন এই শিল্পী। গানে গানে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার এবং বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরই ডাক দেন কোহিনূর। তরুণ সম্প্রদায় তাতে সমর্থন জানায় অকুণ্ঠচিত্তে। ফলে সব মিলিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই বাংলাদেশি। তারই ফলস্বরূপ ২০০৭ সালে নরওয়ের একমাত্র আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নাই টিড তাঁকে দেয় ‘নরওয়েজিয়ান অব দ্য ইয়ার’-এর মতো সম্মাননা।
কেবল নরওয়েতেই গান করেননি কোহিনূর। সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে এসেছেন সুইডেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কাবাসীকে। এর আগে বার দুয়েক বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। ‘তখন কেবল অনাথ আশ্রম এবং সুবিধাবঞ্চিত নারীদেরই দেখেছি আমি। তবে এবার বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের জনগোষ্ঠীর কাছে আসতে পেরেছি। সব দেখে, বিশেষ করে তরুণদের দেখে খুব ভালো লাগল। আমি আশাবাদী, অচিরেই বাংলাদেশ ভালো কিছু করবে। তারুণ্যের শক্তিই আমাকে আশাবাদী করছে এবং এ কারণে আমি গর্বিত।’ বলছিলেন কোহিনূর।
বাংলাদেশের গান নিয়েও উচ্ছ্বসিত তিনি। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের কথা বললেন জোর দিয়ে। আর তবলা! ‘নতুন অ্যালবামের কাজ করছি। হ্যাঁ, এই অ্যালবামে আমি তবলা রাখবই। ভীষণ মনে ধরেছে এই বাদ্যযন্ত্রটি। মোট কথা, বাংলাদেশের ফোক মিউজিক, ঢোলের শব্দ আমার মন কেড়েছে! আর বাংলাদেশি র্যাপারদের বলব, আমরা আপনাকেই খুঁজছি, নতুন অ্যালবামে চাইছি আপনাকে। চাইলেই যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের সঙ্গে।’
0 comments:
Post a Comment