মুন্সিগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এ বৌদ্ধবিহারের সন্ধান মিলেছে। গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগে আর্থিক সহযোগিতা করছে।
বজ্রযোগিনী গ্রামের এ খনন ও গবেষণাকাজের তত্ত্বাবধান করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, স্থাপত্যিক কাঠামো দেখে এটিকে বৌদ্ধবিহার হিসেবে নিশ্চিত করা গেছে। সুনির্দিষ্ট বয়স নির্ধারণ করতে কার্বন-১৪ পরীক্ষার জন্য নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে।
বিহার হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের আবাসিক উচ্চশিক্ষায়তন।
সংবাদ সম্মেলনে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও রাজনীতিক নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘সদ্য আবিষ্কৃত এ বৌদ্ধবিহারের সঙ্গে অতীশ দীপঙ্করের গভীর সম্পর্ক ছিল বলে আমরা মনে করছি। গবেষণা অব্যাহত থাকলে আরও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ও স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হবে।’
২০১০ সালে শুরু হওয়া এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় অংশ নিচ্ছেন ঐতিহ্য অন্বেষণের গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী।
প্রত্নস্থানটির অবস্থান বর্তমান মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানের মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলার অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল প্রাচীন বিক্রমপুর অঞ্চল। অতীতে এ জায়গাটি বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের মধ্যে ছিল। রঘুরামপুর ছিল এর একটি পাড়া। ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়। ভিক্ষু হওয়ার পর তিনি একপর্যায়ে হিমালয়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিব্বতে চলে যান। বাকি জীবন সেখানেই ছিলেন।
যেভাবে খোঁজ মিলল: গবেষকেরা জানান, শুরুতে রামপাল ও বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের নয়টি স্থানে পরীক্ষামূলক খনন চালানো হয়। এর সবগুলোতেই প্রাক-মধ্যযুগীয় মানব বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। ৯ নম্বর স্থানে ইটের দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এটিকে কেন্দ্র করে ৮০ মিটার দীর্ঘ ও ৬০ মিটার প্রস্থ জায়গায় খনন চালানো হলে বৌদ্ধবিহারটির সন্ধান মেলে।
প্রত্নক্ষেত্রটি ঘুরে দেখা যায়, স্থাপত্যটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি দেয়াল একত্র হয়েছে। একটি দেয়াল দক্ষিণ থেকে উত্তরে ও অন্যটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। দেশের অন্য বিহারগুলোর কাঠামোর মতো এটিরও দেয়াল ঘেঁষে ভিক্ষুদের থাকার কক্ষগুলো অবস্থিত। উত্তর দিকের দেয়াল ঘেঁষে ভিক্ষুদের পাঁচটি কক্ষ উন্মোচন করা হয়েছে। পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষেও বের হয়েছে একটি কক্ষ। কক্ষগুলোর আকার সাড়ে তিন বর্গমিটার। কক্ষগুলো ভাগ করা পার্শ্বদেয়ালও খননে পাওয়া গেছে। স্থাপত্যিক কৌশল ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি একটি বৌদ্ধবিহার। নওগাঁর সোমপুর (পাহাড়পুর) মহাবিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের বিহার, ময়নামতির শালবন বিহার এমনকি ভারতের পাটনার নালন্দা মহাবিহারের কাঠামো ও নকশার সঙ্গে এটির মিল রয়েছে।
গবেষকেরা জানান, উন্মোচিত নিদর্শনটির উত্তরে মূল দেয়াল থেকে পূর্বে আরেকটি দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই দেয়ালসংলগ্ন এলাকায় ‘পঞ্চস্তূপ’ (স্তূপ হচ্ছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিশেষ স্থান) পাওয়া গেছে। চার কোনায় চারটি ইটের স্তূপের মাঝখানেরটি পাথরের।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানে আবিষ্কৃত এ বৌদ্ধবিহারটি জরুরি ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আর্থিক সংকট সংরক্ষণের জন্য একটি বাধা—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থবছরের নয় মাস কেটে গেলেও এখনো প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়া যায়নি।’
বিক্রমপুরি বিহার?: ইতিহাসবিদেরা বলেন, প্রাচীন ভারতে পাল সম্রাট ধর্মপালের আমলে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। পাটনার নালন্দা মহাবিহার ও ভাগলপুরের বিক্রমশিলা মহাবিহার, বাংলাদেশের সোমপুর মহাবিহার ধর্মপালের অন্যতম কীর্তি। কিছু ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া গেছে, বিক্রমপুরি নামে একটি বিহারও ধর্মপাল প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে, বিক্রমপুরি বিহার প্রতিষ্ঠায় চন্দ্র বংশের শাসকদেরও অবদান ছিল। তবে ইতিহাসে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এ পর্যন্ত বিক্রমপুরি বিহারের সন্ধান মেলেনি। গবেষক দীপক কুমার বড়ুয়ার বিহারস ইন অ্যানশিয়েন্ট ইন্ডিয়া বইয়ে বলা হয়েছে, বিক্রমপুরি বিহারের অবস্থান ছিল বাংলায়, মগধ রাজ্যের পূর্বে। তবে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
অতীশ দীপঙ্করের সঙ্গে সম্পর্ক: ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বজ্রযোগিনী গ্রামে চন্দ্রগর্ভের (পরে নাম হয় অতীশ দীপঙ্কর) জন্ম হয়। বাল্যকালে তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। ১৯ বছর বয়সে শিক্ষালাভের জন্য যান পাটনার নালন্দা মহাবিহারে। ২৯ বছর বয়সে সেখানে পূর্ণ ভিক্ষু হন। তখন তাঁর নাম হয় অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। দেশে ফেরার পর সম্রাট ধর্মপালের অনুরোধে তিনি ভাগলপুরের বিক্রমশিলা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। তিনি কিছুদিন সোমপুর মহাবিহারেরও অধ্যক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়। অতীশ দীপঙ্কর পরে তিব্বতে চলে যান, বাকি জীবন সেখানেই ছিলেন। ১৬ বছর (মতান্তরে ১১ বা ১৩ বছর) তিব্বতে অবস্থানকালে তিনি বৌদ্ধধর্ম সংস্কারের পাশাপাশি কৃষি ও ওষুধপ্রযুক্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লেখেন। অতীশ দীপঙ্কর বাল্যকালে কোথায় বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা নেন, তা এখনো একটি প্রশ্ন। এখন বিক্রমপুরে বৌদ্ধবিহারের সন্ধান পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলছেন, এই বিহারটির সঙ্গে অতীশ দীপঙ্করের সম্ভবত একটি গভীর সম্পর্ক ছিল।
0 comments:
Post a Comment